|
|
|
|
বিদায়ী ম্যাচ জিতিয়েও ফালোপা শুনলেন ‘গো ব্যাক’
রতন চক্রবর্তী • কলকাতা
ইস্টবেঙ্গল: ২ (খাবরা, মোগা)
পিয়ারলেস: ১ (ক্রিস্টোফার) |
মার্কোস ফালোপা শুভেচ্ছা জানানোর জন্য রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে ছুটছেন তাঁর ফুটবলারদের দিকে। অথচ চিডি, ওপারা, খাবরা-রা কেউ ফিরেও তাকাচ্ছেন না সে দিকে! সবাই যেন কোচকে এড়িয়ে ড্রেসিংরুমে ঢুকে পড়তে পারলে বাঁচেন। ‘ধরা’ পড়ে গেলেন মাত্র দু’জন মোগা আর রবার্ট। তাঁদেরই জড়িয়ে ধরে বর্ষীয়ান ব্রাজিলীয় ভদ্রলোকের অভিনন্দন জানানোর সময়ে মুখটা দেখে খারাপই লাগছিল। কেমন যেন অপরাধী-অপরাধী!
কলকাতা লিগের দ্বিতীয় ম্যাচ খেলে জিতে টানেল দিয়ে ছেলে আমেরিকোকে নিয়ে ফিরছেন ফিফার ইনস্ট্রাকটর হয়ে পঁচাত্তরটা দেশ ঘোরা ফালোপা। গ্যালারি থেকে উড়ে এল ‘গো ব্যাক’ স্লোগান। প্রিয় দলের জয়ের পরেও কোচকে ‘গো ব্যাক’? ময়দানে তো নয়ই, বিশ্বেও কখনও শোনা গিয়েছে কি না সন্দেহ!
তাঁবুতে ঢুকতে যাবেন, আরও বড় ধাক্কা খেলেন সদ্য বিদায়ী ইস্টবেঙ্গল কোচ। সেখানেও চিৎকার, “মর্গ্যান লাও ইস্টবেঙ্গল বাঁচাও।” ফুটবল সচিবের ঠিক করে দেওয়া ‘চিত্রনাট্য’ মেনে যখন সাংবাদিক সম্মেলনে করছেন ক্লাব তাঁবুতে। কঠিন মুখ করেও তেতো গেলার মতো করে বলছেন, “ব্যক্তিগত কিছু কারণে হেড কোচের পদ ছেড়ে দিচ্ছি। ছেলের ইনজুরি নিয়ে কিছু সমস্যা আছে। এই ক্লাবের কর্তা, ফুটবলার কারও সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ নেই,” তখনও বাইরে চলছে ‘মর্গ্যান, মর্গ্যান’ স্লোগান। সমস্যায় থাকা কারখানার গেটের সামনে যেমন হয়! লাল-হলুদের কোনও আধা-সিকি কর্তাকেও সেই সময় দেখা গেল সে সব থামানোর চেষ্টা করতে। উল্টে ক্লাবের অফিস ঘরে আসা চিডিকে দেখা গেল, ইঙ্গিতে সমর্থকদের তাতাতে!
|
শেষ আলিঙ্গন
মোগার সঙ্গে ফালোপা। বুধবার ম্যাচ শেষে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস। |
ট্রেভর মর্গ্যানের বিদায়ের দিনে চিডি-মেহতাবদের আবেগ দেখেছিল যুবভারতী। তার সঙ্গে ফালোপা-বিদায়ের ছবির আসমান-জমিন ফারাক। কেউ বিদায়ী কোচের পাশে নেই। জনাকয়েক আধা কর্তা ঘিরে রেখেছেন। যাতে মিডিয়ার কাছে বেঁফাস কিছু না বলে ফেলেন বাবা-ছেলে। ব্রিটিশ কোচ নিজেই ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন লাল-হলুদ তাঁবু। ফালোপাকে বিদায় নিতে হল তীব্র চাপের মুখে। অত্যন্ত খারাপ কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়ে। ইস্টবেঙ্গলের মতো ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ’ ক্লাবের থেকে যা ঠিক প্রত্যাশিত নয়। এটা তো মোহনবাগানের একচেটিয়া! ফুল-মালা, মিষ্টির প্যাকেট হাতে দিয়ে গাড়ি থেকে মাঝরাস্তায় কোচ নামিয়ে দেওয়ার নজিরও আছে বাগান কর্তাদের। লাল-হলুদও কার্যত তাতে এ দিন নাম লেখাল!
ক্লাবে আসার সময় পদত্যাগের কারণ টাইপ করা দু’পাতায় লিখে এনেছিলেন ফালোপা। পকেটে নিয়ে বসেছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে। ম্যাচের আগে ড্রেসিংরুমে ফুটবলারদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “আজই আমার শেষ ম্যাচ। তোমরা যদি ম্যাচটা জেত, তা হলে একটা সুখস্মৃতি নিয়ে ব্রাজিল ফিরতে পারি।” তখন দেখে কে বলবে লোকটা আর নব্বই মিনিট পরেই ইস্তফা ঘোষণা করবেন? রিজার্ভ বেঞ্চে বসে সারাক্ষণ চিৎকার করছিলেন ‘ওয়েল ডান ফ্রেন্ড’। টিম গোল খাওয়ার পর মাথা চাপড়ালেন। খাবরা-মোগার গোলের পর উচ্ছ্বসিত হয়ে হাততালি দিলেন। গোল নষ্টে আফসোস করলেন অন্য সব ম্যাচের মতোই। ইস্টবেঙ্গল ম্যাচটা জিতেছে, ঠিক। তবে হামাগুড়ি দিয়ে। ডার্বির আগে যা দেখে সমর্থকদের হৃদপিণ্ড কাঁপতে পারে। তা সত্ত্বেও ফুটবল-ঈশ্বর নিপাট ভদ্রলোক ফালোপা-র ‘সুখস্মৃতি’ নিয়ে ফেরায় ব্যাঘাত ঘটাননি। ফালোপাও ঘুরিয়েফিরিয়ে খেলিয়ে সবাইকে খুশি করতে চেয়েছেন।
১১ ম্যাচে ৫ জয়, ২ ড্র, ৪ হার। হারের মধ্যে এএফসি কাপের দু’টো সেমিফাইনাল, টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন কুয়েতের ক্লাবের বিরুদ্ধে। এহেন টিআরপি থাকা সত্ত্বেও কেন ফালোপাকে ইস্তফা দিতে হল, তা নিয়ে ময়দানে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। ফালোপা সেই অর্থে এ দিন কোনও বোমা ফাটাননি। কিন্তু পুরো ঘটনায় তিনি যে অখুশি এবং ক্ষুব্ধ তা ক্লাব সচিবের পাশে বসে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এমনও তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, “আমার ড্রেসিংরুমে বাইশ জন ফুটবলারের মধ্যে পনেরো জনই বেয়াড়া ফুটবলার।” একটু আগেই তাঁর মুখ থেকে এ-ও বেরিয়েছে, “যে সব ফুটবলার আনফিট আর খেলতে পারে না, তারাই পিছনে আমার নামে মিডিয়ার কাছে নানা কথা বলে বেড়াত। কিছু সিনিয়র ফুটবলারও এটা করত। কিন্তু অ্যালভিটো, মোগা, সুয়োকার সঙ্গে কথা বলে আমি তা মিটিয়ে নিয়েছিলাম। পরিবেশ পরিস্থিতি যা তাতে চলে যেতে হচ্ছে।” |
“আমার দলে বাইশ জনের মধ্যে পনেরো জনই বেয়াড়া ফুটবলার।” —মার্কোস ফালোপা |
|
বলব না-বলব না করেও ফালোপার এই জোড়া মন্তব্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর বিদায়-রহস্য। কর্তারা অনেকেই জানাচ্ছেন, ফুটবলারদের বিদ্রোহের জন্য ফালোপাকে সরাতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। টিমের সঙ্গে যুক্ত এক কর্তা সরাসরি বললেন, “আমাদের কিছু করার ছিল না। জনাপাঁচেক ফুটবলার বাদ দিয়ে টিমে তিরিশ জনের কেউ-ই ছিল না ওর সঙ্গে।” অন্য এক কর্তা শোনালেন, “কুয়েত এফসি-র বিরুদ্ধে খেলতে যাওয়ার সময় বিমানে মেহতাব আর কোচ পাশাপাশি সিটে বসেছিলেন। পুরো ফ্লাইটে এক বারও দু’জনকে কথা বলতে দেখিনি।” ক্লাবসূত্রের খবর, লাল-হলুদের এ মরসুমের বিদেশিরা কোচের বিরুদ্ধে কর্তাদের কাছে প্রায় নিয়মিত অভিযোগ জানাতেন। কোচের অহং নিয়েও সরব ছিলেন অনেকে। “লোকটা এত হাইপ্রোফাইল। এত দেশ ঘুরেছে। কিন্তু ম্যান-ম্যানেজমেন্ট শূন্য,” বলছিলেন এক কর্তা। বেশিরভাগ কর্তার অভিযোগ, ফুটবলাররা কোচের স্ট্র্যাটেজি বুঝতে পারতেন না। ভাষা নিয়েও সমস্যা হচ্ছিল।
মর্গ্যানের নাম এ দিন এক বারের জন্যও মুখে না এনেও ফালোপা বলেন, “আমি কিন্তু তিন বছর নয়, চার মাসেই এএফসি কাপ সেমিফাইনালে দলকে নিয়ে গিয়েছি।” সঙ্গে যোগ করেন, “আমি কোলাকো-কে (পড়তে হবে কোলাসো) কোচ করার প্রস্তাব ক্লাবকে দিয়েছি।” যা শুনে ক্লাব সচিব কল্যাণ মজুমদার আবার বলছেন, “ফালোপা ডেড কেস। ও কার নাম বলল, বলল না তা নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নই।” তবে ফালোপার জায়গায় কোচ হয়ে মর্গ্যান বা কোলাসো যিনিই আসুন, তিনি কি পারবেন ইস্টবেঙ্গলকে অধরা আই লিগ দিতে? ডার্বি থেকেই সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হবে। তবে এ দিন ছোট দল পিয়ারলেসের বিরুদ্ধে চিডি-রা যা খেললেন তাতে কিন্তু ইস্টবেঙ্গলকে নিয়ে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না।
ফালোপা বোধহয় ঠিকই বলে গেলেন— “এই টিমটায় পিছনে কথা বলার লোক বড্ড বেশি!”
|
ইস্টবেঙ্গল: গুরপ্রীত, নওবা, উগা (সৌমিক), গুরবিন্দর, রবার্ট, লোবো, সুবোধ, তুলুঙ্গা (চিডি), খাবরা, মোগা (সুয়োকা), বলজিৎ। |
পুরনো খবর: ইস্টবেঙ্গলে ফিরতে চেয়ে আবেদন করলেন মর্গ্যান |
|
|
|
|
|