এ যেন এক নতুন কলকাতার জন্ম!
সেকেলে উপনিবেশের ধ্বংসস্তূপে নয়। নতুন ঠিকানায়, নতুন পরিচয়ের সন্ধান। বিমানবন্দরের কাছে নিউ টাউনের দশ একর জমি থেকে নতুন উড়ানের স্বপ্ন দেখছে মহানগর। বেজিং অলিম্পিকের বিখ্যাত পাখির বাসা স্টেডিয়াম বা লন্ডনের টেট মডার্ন আর্ট গ্যালারির রূপকার সুইস সংস্থা (অ্যারজগ অ্যান্ড দো ম্যুরঅঁ)-র স্থাপত্য-ভাবনাও মিশছে সেই স্বপ্নে। কবেকার রাইটার্স বিল্ডিং, ভিক্টোরিয়া বা হাওড়া ব্রিজের মতো যা হয়তো এক দিন কলকাতার মুখ হয়ে উঠবে।
এই স্বপ্নসৌধের নাম ‘কলকাতা মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট’ (কেমোমা)। আজ, বৃহস্পতিবার দুপুরে নিউ টাউন এলাকার ইকো-ট্যুরিজম পার্কের কাছে যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সুদৃশ্য দশতলা ভবনের নির্মাণ শেষ হতে লাগবে তিন বছর। ৫৫০,০০০ বর্গ ফুটব্যাপী ভবনটির নকশায় এক সঙ্গে অনেকগুলো যুগের হাত ধরাধরি। প্রাচীন বৌদ্ধ স্তূপের আদল মিশেও জেগে থাকছে এক ধরনের কালনিরপেক্ষ নাগরিক বিমূর্ততা। দু’টি অংশের একটিতে শিল্প মিউজিয়াম। তাতে বিশ্বমানের ৪৪টি আর্ট গ্যালারি, স্টুডিও, শিল্প সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার কেন্দ্র, গ্রন্থাগার। আর একটি অংশে জমাটি নাগরিক চত্বর (প্লাজা), বিশাল অ্যাম্ফিথিয়েটার, প্রেক্ষাগৃহ, শিল্প-বিপণি, রেস্তোরাঁ— পর্যটকদের জন্য ভরপুর আকর্ষণ। কলকাতার আবহাওয়ার মেজাজ-মর্জির কথা মাথায় রেখেই শিল্পকর্ম প্রদর্শনের উপযোগী আলো-হাওয়া দেদার খেলবে এই ভবনে। শুধু কলকাতা নয়, ভারতে এই প্রথম এত বড় মাপের কোনও স্থাপত্যের কাজের সঙ্গে যুক্ত হল অ্যারজগ অ্যান্ড দো ম্যুরঅঁ। “মুখ্যমন্ত্রীর হাতে বাংলার সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের চেষ্টার সঙ্গে এই উদ্যোগটি সঙ্গতিপূর্ণ,” বলছেন সিমা আর্ট গ্যালারির অধিকর্তা তথা কেমোমা-র ম্যানেজিং ট্রাস্টি রাখী সরকার। |
কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তার ব্যাপারে কথা চলছে। রাজ্য সরকার জমি দেওয়া ছাড়াও এক-তৃতীয়াংশ সাহায্যে অঙ্গীকার করেছে। গোটা দেশের শিল্পীরা মিলে নিউ ইয়র্কে এক নিলাম আয়োজনের মাধ্যমে তহবিল গড়া শুরু করেন বছর ছয়েক আগেই। কর্পোরেট সাহায্যও আসতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েছে ২০ কোটি টাকা। রাখীদেবী আশাবাদী, “নির্মাণ কাজ এক বার শুরু হলে হু-হু করে কর্পোরেট পুঁজি আসবে। সাধারণ নাগরিকেরা যাতে এমন স্বপ্নের শরিক হতে পারেন, তহবিল গড়ার কাজে তাঁদেরও সঙ্গে রাখা হবে।”
কলকাতার জন্য এ এক বিরাট প্রাপ্তি হয়ে উঠতে পারে, বলছেন এ শহরের শিল্পরসিকেরা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক তথা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের প্রাক্তন কিউরেটর স্বপন চক্রবর্তীর মনে পড়ে যাচ্ছে, তিন দশক আগে এ শহরে রদ্যাঁর ভাস্কর্যের প্রদর্শনীর সময়ে উপযুক্ত ঠাঁইয়ের অভাবে আয়োজকদের নাজেহাল হওয়ার ঘটনা। বছর দশেক আগে পাবলো পিকাসোর ছবির প্রদশর্নী এ দেশে এলেও পরিকাঠামোর খামতিতেই কলকাতাকে এড়িয়ে গিয়েছিল। স্বপনবাবুর কথায়, “প্রদর্শনকক্ষে উপযুক্ত আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, আলোর অভাবে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনীও করা সম্ভব হচ্ছে না কত যুগ!” ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ-এর প্রাক্তন কর্তা, ইতিহাসবিদ সব্যসাচী ভট্টাচার্যেরও আশা, “বিশ্বমানের আর্ট গ্যালারির নিরিখে এ বার অনায়াসে দুনিয়ার প্রথম সারিতে উঠে আসবে কলকাতা।”
চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরীও তৃপ্ত, এত দিন বাদে কলকাতা তথা বাংলার আধুনিক শিল্পকলা চর্চার একটি মিউজিয়াম গড়ে উঠছে। কালীঘাটের পট, বটতলার উডকাট থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে গণেশ পাইনদের সময় ছুঁয়ে শিল্পচর্চার সমকালও কেমোমা-তে ঠাঁই পাবে। কেমোমা-র বোর্ড অব ট্রাস্টি-র চেয়ারম্যান তথা শিল্পপতি ব্রিজমোহন খেতান বলছেন, “এখনকার শিল্পীদের আর নিজেদের কাজের প্রদর্শনী, রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা বিপণন নিয়ে ভাবতে হবে না। ওঁরা পুরোপুরি সৃষ্টিতে মন দিতে পারবেন।”
শিল্প সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধারের চর্চায় পঠনপাঠন, কর্মশালা আয়োজনের বিষয়টি প্রভূত গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিকতাবোধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার শিক্ষা-সংক্রান্ত উপদেষ্টামণ্ডলীতে দেশ-বিদেশের নামজাদা শিল্প-প্রতিষ্ঠান, সংগ্রহালয়ের পণ্ডিতদের ছড়াছড়ি। শিল্পকলার ইতিহাস ও সংরক্ষণ-বিষয়ক চর্চার বিশিষ্ট কেন্দ্র লন্ডনের কুর্টোল্ড ইনস্টিটিউট অব আর্ট-এর সঙ্গে মাঝেমধ্যেই গাঁটছড়া বেঁধে কাজ করবে কেমোমা।
বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের মধ্যে সমন্বয়ের একটি পরিসরও গড়ে উঠবে কেমোমা-তে। থিয়েটারের ক্ষেত্রে অনেক নিরীক্ষাই এখনও কলকাতার অধরা বলে মনে করেন নাট্যপরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। যেমন একটি বাঁধাধরা মঞ্চের উপরে নির্ভর না করে, তা ভেঙেচুরে উপস্থাপনার ভোল পাল্টে দেওয়ার স্পর্ধা। কেমোমা-তে কলকাতার জন্য এমন বিচিত্র সৃষ্টিশীলতার দরজা খুলে যেতে পারে!
সব্যসাচীবাবু, স্বপনবাবু, যোগেনবাবু ও সুমনবাবু চার জনেই থাকছেন প্রতিষ্ঠানের প্রোগ্র্যাম কমিটিতে। ট্রাস্টিদের দাবি, দেশ-বিদেশ ঘুরে দেখে যে ভাবে ভাবা হয়েছে, শিল্প বিষয়ে এমন সমগ্রতাবোধে ভরপুর কর্মকাণ্ড, দুনিয়ার খুব বেশি প্রতিষ্ঠানে নেই। নিস্ফল অতীতচারিতা নয়, অতীতের হাত ধরে ভবিষ্যতের দিশা খোঁজাই কেমোমা-র অঙ্গীকার।
|