শিল্পিত স্থাপত্যের নয়া ইমারত কেমোমা
রাক বা ইরানের মরুভূমিতে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া, প্রাচীন স্তেপ পিরামিড বা ‘জিগগুরাত’। একুশ শতকের আধুনিক পৃথিবীতে যদি তারই সঙ্গে মিশে যায় চতুষ্কোণ, ‘ব্লক বাই ব্লক’ প্যাটার্নের আধুনিক স্থাপত্য?
আর সেই আধুনিক স্থাপত্যের প্রতিটি তলের কার্নিসে যদি মিশে থাকে মুঘল আমলের জাফরি-শৈলী?
আলো, হাওয়া ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার সেই মেলবন্ধন বেয়ে যদি গড়ে ওঠে দশ তলা এক বাড়ি?
যার বিভিন্ন তলে চিত্রকলা ও ভাস্কর্য প্রদর্শনের জন্য ৪৪টি গ্যালারি। কোনও গ্যালারি উনিশ শতক থেকে আজকের ভারতীয় চিত্রকলার জন্য। কোনওটি ইউরোপ, আমেরিকা, চিন বা জাপানের শিল্পের জন্য। গ্যালারিগুলি প্রথম, তৃতীয়, পঞ্চম...ইত্যাদি বেজোড় তলে। তারই মধ্যে কোথাও ছবি রেস্টোরেশনের উইং, কোথাও বা লেকচার থিয়েটার, লাইব্রেরি। খোলামেলা পরিবেশ।
যে কোনও তলে দাঁড়িয়ে পুরো স্থাপত্যটা এক লহমায় ঠাহর করা যায়।
লন্ডনের টেট মডার্ন (মিউজিয়াম) বা তিন বছর আগে বেজিং অলিম্পিকের জন্য ‘বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়াম’ তৈরি করেছিল যারা, সুইৎজারল্যান্ডের সেই ‘হারজগ অ্যান্ড ডি মিউরোঁ’ সংস্থার উদ্যোগে এই বছর থেকেই রাজারহাটে নির্মাণ শুরু হবে এই স্থাপত্যের। ‘কলকাতা মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট’ বা কেমোমা। ২০১৪ সালে শেষ হবে নির্মাণ।
‘কেমোমা’-র অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে ম্যানেজিং
ট্রাস্টি রাখী সরকার এবং শিল্পী যোগেন চৌধুরী। ছবি: অশোক মজুমদার
গত কয়েক বছর ধরে প্রায় ১৪টি ওয়র্কশপ পেরিয়ে অবশেষে ‘কেমোমা’র নকশা চূড়ান্ত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে শুক্রবার বিকেলে টাউন হলে ভিডিও প্রেজেন্টেশনে দেখানো হল সেই চেহারা। রাজারহাটে এই ‘কেমোমা’র হাত ধরেই অবশেষে মুক্তি পেতে চলেছে নেহরু-উত্তর ভারতীয় স্থাপত্য।
ইটের পর ইট চাপালেই যে স্থাপত্য হয় না, ব্রিটিশরা জানত। তাই নতুন দিল্লি তৈরির সময় কেমন হবে ভাইসরয়ের প্রাসাদ, কেমন হবে আইনসভা, তার জন্য ডাকা হয়েছিল বিখ্যাত স্থপতি এডুইন লুটিয়েন্সকে। স্বাধীন ভারতে চণ্ডীগড় তৈরির জন্য জওহরলাল নেহরু ডেকে পাঠিয়েছিলেন ফরাসি স্থপতি লে করবুসিয়েরকে। মার্কিন স্থপতি লুই কানের পরিকল্পনায় তৈরি হয় আইআইএম আমদাবাদ। ভারী জগদ্দল কাঠামো নয়, হাল্কা ডাক্টের মধ্যে দিয়ে আলো আর হাওয়ার বয়ে যাওয়া। সাধে লুই কানকে বলা হত ‘স্থাপত্যের দার্শনিক!’ এই বিখ্যাত স্থপতিরা সবচেয়ে বেশি জোর দিতেন দেশজ পরিবেশ ও আলো-হাওয়ার উপরে! করবুসিয়ের বলেইছিলেন, “আলোয় যে আকার এবং আয়তন দেখা যায়, তা নিয়ে মেধাবী খেলার নামই স্থাপত্য।” ‘কেমোমা’য় আলো-হাওয়ার ওই ‘মেধাবী’ খেলার জন্যই যে কোনও অলিন্দে দাঁড়িয়ে ঠাহর করা যাবে গোটা বাড়িটাকে।
নেহরু-উত্তর ভারতের মাটিতে অনেক বহুতল অট্টালিকা, ব্রিজ, বিমানবন্দর তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোথায় সেই শিল্পিত স্থাপত্যনিশান? সর্বত্র শুধু কংক্রিটের বহুতল, দেশজ আলো-হাওয়ার সঙ্গে যোগ না রেখে মার্কিন আদলে ‘স্টিল অ্যান্ড গ্লাস’ কাঠামো। সত্যি কথা বলতে কি, গত শতকেই উদার অর্থনীতিতে উত্তরণ ঘটে গিয়েছে এই দেশের। কিন্তু স্থাপত্য সেই ‘যথা পূর্বং, তথা পরং’।
অন্য দিকে? পাপড়ি মেলা ফুলের মতো ‘সিডনি অপেরা হাউস’ আজ বিশ্ব-সংস্কৃতির ঐতিহ্য। ষাটের দশকে তৈরি নিউ ইয়র্কের টিডব্লিউএ বিমানবন্দরের গড়নেও যেন পাখি উড়ে যাওয়ার গতিমত্তা। আর এখন? দুবাইয়ের ‘বুর্জ অল আরব’ ছেড়ে দিন। সেখানে না-হয় শুধুই পেট্রো ডলারের গগনচুম্বী ঔদ্ধত্য। কিন্তু স্থাপত্যের মুক্তি? সে তো প্রতি মুহূর্তে ঘটে যাচ্ছে চিন, জাপান, সিঙ্গাপুরে। বেজিং বিমানবন্দরে একই ছাদের নীচে সব ক’টি টার্মিনাল। আর দেওয়ালে শুধুই লাল, হলুদ আলো। সাংহাইয়ের ১০০ তলা ‘ওয়র্ল্ড ফিনান্সিয়াল সেন্টার?’ লম্বা গড়ন। বাতাসের চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে ১০১ তলার সবচেয়ে উঁচুতে আয়তাকার শূন্যস্থান। সিঙ্গাপুরের ‘সুপ্রিম ল কোর্ট’। দ্বীপের পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বাড়ির উপরে চক্রাকার এক কাঠামো। দুনিয়ার স্থাপত্য আজ এই রকমই ‘মিনিমালিস্ট’।
এই রকমই হবে ‘কেমোমা’র চেহারা।
আর কলকাতা? ব্রিটিশ আমলের পর দেশভাগ আর উদ্বাস্তুর চাপে নাভিশ্বাস-ওঠা এই শহর স্থাপত্য নিয়ে ভাবেইনি, তার বেঁচে থাকার ছন্দ তখন শুধুই ‘ইটের পর ইট, মাঝে মানুষকীট।’ কেমোমা অন্তত স্থাপত্যের সেই চক্ষুযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চলেছে এই শহরকে, এই দেশকেও। সাধে টাউন হলের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “এটা শুধু ভারতের সেরা সাংস্কৃতিক ঠিকানাই হবে না, দেখতে হবে যেন সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক আগ্রহের কেন্দ্র হয়ে ওঠে!”
চিন, জাপানের আধুনিক স্থাপত্যের মতো রাজারহাটেও দশ তলা ওই বাড়িতে উঠতে উঠতেই এক সময় দূরে দেখা দেবে শিল্পীদের বাড়িগুলি। দেশ, বিদেশ থেকে বিভিন্ন শিল্পীরা সেখানে এসে থাকবেন, ওয়র্কশপ করবেন। আর একটু দূরে নীচে তাকালে ৫০০ আসনের অডিটোরিয়াম। থাকছে বিশাল অ্যাম্ফিথিয়েটার। প্রায় দেড় হাজার দর্শক একত্র বসতে পারেন সেখানে। ‘কেমোমা’ শুধুই চিত্রকলা, ভাস্কর্য আর ইনস্টলেশন প্রদর্শনীর জন্য নয়। ফটোগ্রাফি, নাচ-গান-বাজনা... ‘পারফরমিং আটর্স’-এরও সমান গুরুত্ব সেখানে। ভারতের আর কোনও গ্যালারিতে আজও এত বিপুল ভাবে বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের পারস্পরিক কথোপকথন চলে না।
ভবিষ্যতে মেট্রো রেলেই সটান পৌঁছে যাওয়া যাবে শহরের এই নতুন ঠিকানায়। “একটা মেট্রো স্টেশন হবে কেমোমার কাছে। এটা আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল,” বললেন মুখ্যমন্ত্রী। পরিকল্পনা? সরকার এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগের ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ’-এর যে সুচারু উদ্যোগে কেমোমা গড়ে উঠছে, ম্যানেজিং ট্রাস্টি রাখী সরকার সেই কথাই বলছিলেন। ৪১০ কোটি টাকার এই প্রকল্প পুরোটা সরকারের পক্ষে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। “কিন্তু সরকারি ভিত্তি আর তার সঙ্গে বেসরকারি ক্ষেত্রের পেশাদারি নৈপুণ্য, এই দুয়ের মিলমিশেই গড়ে উঠবে কেমোমা,” বললেন তিনি। রাজ্যের অনেক শিল্পপতিই এ দিন টাউন হলে হাজির, তাঁরা সকলেই কলকাতার এই নতুন স্থাপত্য-ঠিকানার বিপুল অর্থযোগের শরিক।
এখন শুধুই ২০১৪ সালের অপেক্ষা!
First Page Calcutta Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.