দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে এখনও একটাও বল পড়েনি এটা একমাত্র ওয়াংখেড়ে মাঠের স্কোরবোর্ডই বলছে। স্কোরবোর্ডকে কী আর সাধে গাধা বলা হয়! সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের ইনিংস তো সোমবারের মুম্বইয়ের সকাল থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। আর সেটা সেঞ্চুরিয়নের ইনিংস বা শারজার মরুঝড়ের মতোই সাররিয়াল হয়ে উঠেছে। কখনও মনে হচ্ছে, আরে বাস্তব তো বটেই। চোখের সামনে ঘটছে দেখতে পাচ্ছ না? আবার পর মুর্হূতেই মনে হচ্ছে মায়াবী। এ রকম কি বাস্তবে হতে পারে নাকি? হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা তো একটা কাল্পনিক সৃষ্টি। নাগরিক জীবনে একটা মানুষের চৌম্বকীয় চৌহদ্দিতে পড়ে সবাই এমন আকর্ষিত, দিনভর তাকে নিয়ে চর্চা-বৈঠক কোনও ক্রীড়াবিদকে ঘিরে হয় নাকি? নাকি কখনও হয়েছে? কলকাতায় সাড়ম্বরে পালিত আধডজন পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ একত্রিত করে দশ দিয়ে গুন করুন। মুম্বইয়ের বর্তমান অপার্থিব মহল সামান্য বোধগম্য হবে।
রাত্তির এগারোটার সময় টিম হোটেলের বিজনেস সেন্টারে বসে দেখছি, গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া-র সামনে একদল লোক দাঁড়িয়ে মোবাইলে টিম হোটেলের ছবি তুলছে। আর সেই তাজমহল হোটেলের লিফটে বড় করে লেখা রয়েছে ‘সচিন ফরএভার’। টিম হোটেলের লিফটে এ ভাবে আর কখনও সম্মান জানানো হয়েছে? মনে পড়ে না। ছন্দপতনের জন্য টুকরোটাকরা কাঁটার অভাব মোটেও নেই। জাভেদ মিয়াঁদাদ যেমন সাফ বলছেন, “সচিনের অবসর আরও এক বছর আগে হওয়া উচিত ছিল। ও দেরি করে ফেলেছে।” শোয়েব আখতার যেমন এ দিন আনন্দবাজারকে বললেন, “সচিনের ভাগ্য ভাল ও পাকিস্তানের হয়ে খেলেনি। খেললে ইনজামামের মতো ছ’সাত বছর আগে চলে যেতে হত। আজকের এই সম্মান-টম্মান কিছুই জুটত না। বিসিসিআই সচিনের জীবনে একটা বড় হাতিয়ার।”
সমস্যা হল সচিন-বন্দনার এমন লাভাস্রোত চারপাশ থেকে উৎসারিত হচ্ছে যে, মুহূর্তে তলিয়ে যাচ্ছে এ সব কুটোকাটা। এক জনেরও মনে পড়ছে না সচিনের যেমন দুশো টেস্ট, শিবনারায়ণ চন্দ্রপলেরও তেমনি এটা দেড়শোতম টেস্ট। অঞ্জলি তেন্ডুলকর বলছিলেন, “বেচারিকে নিয়ে অনেক প্রচার হওয়া উচিত ছিল।” তাঁর যতই ‘বেচারি’ মনে হোক, তাঁর স্বামীকে ঘিরে এতই মাধ্যাকর্ষণ যে চন্দ্রপল আপাতত অন্য সৌরজগতে নিক্ষিপ্ত। রোমান্স শুধুই একতরফা ভাবে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মহানায়ককে ঘিরে।
পেলের সান্তোসের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলা আজও রোমান্সে বরণীয়। মাইকেল জর্ডনের শেষ ম্যাচ। বা, ইউএস ওপেনে ক্রিস এভার্টের হেরে অবসর নেওয়া। যেখানে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জিনা গ্যারিসন ম্যাচ জিতে কাঁদছেন। ক্রীড়া-অবসরে এগুলো যুগান্তকারী। ক্রিকেটে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য স্টিভ ওয়-র সিডনি ক্রিকেট মাঠের ড্রেসিংরুমে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। সচিনকে নিয়ে যা চলছে তা এগুলোর পাশে বসতে তো পারেই, বরঞ্চ সব কিছুকে বোধহয় ছাপিয়ে যাচ্ছে।
ষোলো বছর বয়সে যে দিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম খেলতে নামলেন, সে দিন থেকেই সচিন রূপকথার গাছ। আজ শেষ করার সময়েও যে রূপকথা থেকেই বিদায় নিচ্ছেন। নইলে বিষেণ সিংহ বেদীর মতো ঠোঁটকাটা (বুঝতে হবে চিরনিন্দুক) মানুষ কী করে প্রকাশ্য সমাবেশে বলেন, “আমার ভাবতে গর্বিত লাগছে মুম্বইয়ের এই যে বাতাসে আমি নিঃশ্বাস নিচ্ছি, সেখানে সচিন তেন্ডুলকরও নিঃশ্বাস নেয়।” ব্রায়ান লারা বলেন, “কোনও তুলনাই হয় না আমার আর ওর চাপ নেওয়ার! আমাকে খেলতে হত তিরিশ লাখ মানুষের জন্য। সচিন চব্বিশ বছর ধরে চাপ নিয়েছে একশো কোটিরও বেশি মানুষের!” ওয়াকার ইউনিস বলেন, “সচিন প্রথম যখন খেলতে এসেছিল পাকিস্তানে, এত বাচ্চা যে, ভাবিইনি একে দিয়ে কিছু হবে। আজ জানি ছেলেটার মধ্যে কী মশলা ছিল। অনবদ্য। একই সঙ্গে শুরু করে দশ বছর আগে খেলা ছেড়েছি। আমার কমেন্ট্রি ছাড়ারও সময় হয়ে গেল। সচিন কিনা আজও খেলছে।” জাভাগল শ্রীনাথ তাঁর জীবনে খেলোয়াড় এবং ম্যাচ রেফারি হিসেবে এত এত প্লেয়ার দেখেছেন। নেটে টানা তিন ঘন্টা এত মন দিয়ে প্র্যাকটিস করতে কাউকে দেখেননি। বলেন, “অবসর নিয়ে অন্তত মেন্টর হিসেবে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে ফেরত আসুক। পরের বিশ্বকাপে থাকুক ধোনিদের সঙ্গে। সচিনের প্রতিটা রক্তবিন্দুই তো ক্রিকেটের জন্য।” |
এমনিতে ওয়াংখেড়ে মাঠের মধ্যে কোথাও দু’শোতম টেস্টের জন্য সচিনকে বাড়তি শুভেচ্ছা। তাঁর কাট আউট। বা ছবি কিছুই চোখে পড়ল না। ইডেনে বরঞ্চ বাহ্যিক আবহটা অনেক সচিনময় ছিল।
কিন্তু মুম্বইয়ের পাকস্থলীতে সচিন এমন ভাবে বরাবর উপস্থিত। আর যেহেতু এটাই তাঁর বিদায়ী ম্যাচ, বেহালার সুরটা আরব সাগরের ধারে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে আরও বেশি। ইন্ডিয়া টুডে গোষ্ঠী আয়োজিত ‘সেলাম সচিন’ সম্মেলনে সুরেশ রায়না যেমন বলছিলেন, ড্রেসিংরুমে কিশোর কুমারের গান আর কেউ আই প্যাডে জোর করে দেবে না। টিমের ইয়ং ছেলেরা এমনিতেই অন্য সব গান শুনতে চায়। রায়না এক লাইন গাইলেনও ব্যাট করতে যাওয়ার আগে ড্রেসিংরুমে সচিনের চালিয়ে রাখা বরাবরের যেটা প্রিয় গান।
‘লেহেরো কি তরা ইয়াদে দিল সে টকরাতি হ্যায়...।’
রায়না জানালেন, ধোনির রাজ্যপাটেও সচিনের কেমন বিশেষ ভূমিকা থেকে এসেছে সে সব কথা। মোহালির বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে তটস্থ দু’টো টিম। সচিন এসে আলাদা ক্লাস করলেন টিমের। জুনিয়রদের সাহস দিলেন, “পাকিস্তান চাপের মুখে ভেঙে পড়ে। ওদের প্রেশার দিতে হবে। বিশিষ্ট অতিথিদের নিয়ে মাথা ঘামিও না। মনে রেখো, বিশ্বকাপে আমাদের রেকর্ড অনেক ভাল।” এর পর ফাইনালে গিয়ে টস নিয়ে ধোনি-সঙ্গকারার মধ্যে বিতর্ক বাধল। টস হল দু’বার করে। সচিন আবার অভিভাবকের ভূমিকা নিলেন। সবাইকে জড়ো করে বললেন, “ছুটকো ঘটনা নিয়ে মাথা খারাপ কোরো না। সবাই খেলায় মন রাখো।”
পাঁচতারা হোটেলে যখন এইসব আলোচনা হচ্ছে, ওয়াংখেড়েতে একই সময় সচিন নেট করে যাচ্ছেন! সম্মেলনে তাঁর বেটার হাফ অঞ্জলি এসেছিলেন। সচিন প্র্যাকটিস কামাই করে থাকবেন কী করে? জীবনে কখনও করেছেন নাকি! জীবনের শেষ দিনের আগের দিনের নেট প্র্যাকটিসেও সেই একই রুটিন। সুনীল গাওস্কর এ দিন বলছিলেন, শুধুই তাঁর ওপর সিদ্ধান্তটা ছাড়া থাকলে ছিয়াশিতেই অবসর নিয়ে নিতেন। সাতাশি অবধি অপেক্ষা না করে। শেষ দিকটা তিনি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। স্লিপে দাড়িয়ে স্কোরবোর্ড দেখতেন, খেলা শেষ হতে আর কত ওভার? সচিনের নেট জীবনে সে সবের অবকাশ নেই। জীবনের শেষ টেস্টের অনুশীলন ভঙ্গিও প্রথম টেস্টের মতোই! দু’বার ব্যাট করলেন। তার সঙ্গে একবার থ্রো ডাউন। সব মিলিয়ে ব্যাট হাতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। অর্জুন প্র্যাকটিসে ঢুকে পড়েছিল বলে মধ্যিখানে তাকে ধমক দিলেন। তার পর আবার বরাবরের মতোই মগ্ন হয়ে পড়লেন অনুশীলনে। পয়লা নম্বর-দুশো নম্বর সব এক!
প্যাভিলিয়নের সিড়ি দিয়ে চিল-চিৎকারের মধ্যে ওঠার সময় পাশ থেকে দেখে মনে হল খুব রিল্যাক্সড। সকালে শুনলাম, হোটেলে নীচে নেমে ব্রেকফাস্টও করেছেন। রুম সার্ভিস অর্ডার দেননি। দেশে যেটা বরাবর করে থাকেন। সহজ অর্থ, বিদায়ী ম্যাচে চাপে না গুমরে থেকে অভিজ্ঞতাটা উপভোগও করতে চাইছেন। অনুশীলনের ধর্মে যদিও নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। অত্যন্ত প্রতিভাবানকেও সেখানে নম্র ভাবে সেরা শ্রমিক হতে হবে। ধোনি তো অনুশীলনের এই স্টাইল দেখেই বারবার তারিফ করেন, ক্রিকেট যদি রাম হয়, সচিন হনুমান। রামের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেবক।
শেষ লাইনটা লিখতে গিয়ে ব্রায়ান লারার কথা মনে পড়ে গেল। লারা বলছিলেন, “আমার যদি একটা ছেলে থাকত আর সে আমার পুরনো ইনিংস ইউ টিউবে হাতড়াতে যেত, আমি ওকে বলতাম এগুলো সব উড়িয়ে দাও। ইউটিউব থেকে সচিনের ইনিংসগুলো খুলে দেখো। দেখো ও টেকনিক্যালি কত নিখুঁত। শিখতে হলে ওকেই ফলো করো।”
শেষ লাইনটা লিখতে গিয়ে তাই বিকল্প চিন্তা মাথাচাড়া দিচ্ছে। সাররিয়াল কেন? এটাই তো হওয়ার ছিল!
|