বক্তার নাম অজিত তেন্ডুলকর! সচিনের ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড। অথচ মিডিয়ার শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে এমনই দুষ্প্রাপ্য থেকেছেন যে, ভাবাই যায় না। ইদানীং কিছু টিভি আবির্ভাবে সম্মত হলেও প্রিন্ট মিডিয়ায় ইন্টারভিউ দেননি। ক্রিকেট নিয়ে যদি বা এক-আধবার কথা বলানো গিয়েছে, সচিন নিয়ে কখনও মুখ খোলেন না। মঙ্গলবারও প্রভূত ধস্তাধস্তির পর তবেই অজিতের সাক্ষাৎকার নেওয়া গেল। তার আগে একটা টক শো-তেও বেশ কিছু কথা বললেন। ভাইয়ের অবসরের প্রাক্কালে চিরকালের পর্দানশিন মানুষটার মুখ খোলার বিরল মুহূর্ত...। |
মাইক্রোফোন হাতে দাদা অজিত। মঙ্গলবার ছবি তুলেছেন উৎপল সরকার। |
প্রশ্ন: এখনও ইন্টারভিউ দিতে আপনার এত সমস্যা কেন?
অজিত: আমি আড়ালে থাকা পছন্দ করি। চিরজীবন তেমনই থেকেছি। সেটাই ভাল নয় কি!
প্র: তা বলে আপনি চব্বিশ বছর যা করে এলেন, সেটা তো অবিশ্বাস্য!
অজিত: সচিন খেলছে। ওর ওপর ফোকাসটাই তো থাকা ভাল, তাই নয় কি? আমি তো অন্দরমহলের লোক।
প্র: সবাই বলছে ক্রিকেট বাদ দিয়ে সচিন থাকবেন কী করে? কী করে ঢাকবেন এই বিশাল শূন্যতা? কেউ ভাবছে না অজিত তেন্ডুলকরের জীবনেও তো বিশাল শূন্যতা আসতে যাচ্ছে। তারও তো সব কিছু ছিল সচিনের ক্রিকেট জীবন! অজিত, আপনার শূন্যতা ঢাকা নিয়ে কিছু ভেবেছেন? অজিত: না, এখনও ভাবিনি। জানি না কী করব।
প্র: মনে হচ্ছে মুম্বইয়ের ময়দানে আপনি নতুন করে টহল দেওয়া শুরু করবেন। পরের সচিনদের যদি আবিষ্কার করা যায়।
অজিত: নাহ, ময়দানে যাওয়ার আর প্রশ্ন উঠছে না। আমার কাজ তো শেষ। আর নতুন করে চরতে বেরিয়ে কী হবে।
প্র: নতুন সচিন খুঁজবেন?
অজিত: নাহ, অনেক হয়ে গেছে। আর নয়।
প্র: মুম্বইয়ের ময়দানে বলা হয়ে থাকে, যত দিন ক্রিকেট থাকবে, তত দিন সচিন থাকবেন। আর বলা হয়, যত দিন সেই জিনিয়াসকে তারিফ করা হবে, তত দিন তাঁর পিছনে এক ভাইয়ের ত্যাগও চর্চিত হবে।
অজিত: ত্যাগ শব্দটা ব্যবহার করবেন না প্লিজ। ওটাতে আমার আপত্তি আছে।
প্র: কেন?
অজিত: আমি শুধু ওর সঙ্গে থেকেছি। সচিন এত প্রতিভাবান আর তার সঙ্গে এত ডিসিপ্লিনড যে, বাকি কাজটা ও-ই করেছে।
প্র: আচ্ছা, ওঁকে টিমমেটরা কেউ ডাকে তেন্ডলা। কেউ ডাকে সচ। আপনি ভাইকে কোন নামে ডাকেন?
অজিত: (হাসি) আমি সচিন বলি।
প্র: একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে। সচিন দুম করে হঠাৎ অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন কেন? ঠিক তো ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা যাবেন।
অজিত: এই প্রসঙ্গটা জরুরি কি (সামান্য অস্বস্তিতে)?
প্র: নিশ্চয়ই জরুরি। হঠাৎ কী এমন ঘটল যে, সিদ্ধান্তটা বদলে গেল?
অজিত: মাঝখানে যে ছ’মাস গ্যাপ ছিল, সেই সময়ই সচিন ভাবছিল কী করা উচিত। ও এখন ওয়ান ডে খেলে না বলে মধ্যিখানে প্র্যাকটিসের সুযোগও পায়নি। তখনই নানা রকম পরিকল্পনা মাথায় ঘুরছিল। তার পর সবাই মিলে কথাবার্তা হল।
প্র: অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে শেষ টেস্টে আপনাকে একদিন কোটলার গ্যালারিতে পাওয়া গিয়েছিল। তা নানান গুজবেরও জন্ম দিয়েছিল যে, নির্ঘাত সচিনের এটা বিদায়ী টেস্ট। নইলে সচিন ব্যাট করার সময় যাকে লোকচক্ষুতে কখনও দেখা যায় না, সে হঠাৎ দিল্লি উড়ে আসবে কেন?
অজিত: হ্যাঁ, কোটলায় অনেক দিন পর গিয়েছিলাম।
প্র: সচিনের ম্যাচ চলছে এমন অবস্থায় সাহিত্য সহবাসে গিয়ে দেখেছি যে, বেল বাজালেও আপনি খোলেননি। দুপুর বারোটাতেও দরজার বাইরে কাগজ পড়ে রয়েছে। দুধ পড়ে রয়েছে। সব জানালা বন্ধ। অথচ ভেতরে লোক আছে। সচিন ব্যাট করলে দিনের পর দিন এটাই থেকেছে আপনার রুটিন। আবার কেউ বলত, গাড়ি নিয়ে আপনি অজানা গন্তব্যে বেরিয়ে পড়তেন।
অজিত: ঠিকই। আমরা সচিনের খেলা কখনও লাইভ দেখতাম না। বাড়িতে থাকলেও টিভি বন্ধ করা থাকত। বা লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়তাম। ভিস্যুয়ালাইজ করতাম, ও দারুণ ব্যাট করছে। সলিড সব ড্রাইভ খেলছে। পুল করছে। সচিন ক্রিজে থাকার সময় আমার মা প্রার্থনায় বসতেন। অঞ্জলি নির্দিষ্ট একটা জায়গায় বসে থাকত। আমার বড় ভাই আর তার স্ত্রী, বোন আর বোনের হাজব্যান্ড সবাই মিলে প্রার্থনা করত যে, দুমদাম মারতে গিয়ে ও যেন উইকেট না দিয়ে আসে।
প্র: এতটাই কুসংস্কারগ্রস্ত আর ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন সচিন তেন্ডুলকরের পরিবার হয়েও! সচিনকে তো উল্টে বোলাররা চব্বিশ বছর ভয় পেয়ে এসেছে।
অজিত: দেখুন, ব্যাটসম্যান ক্রিজে পৌঁছে গেলে পৃথিবীর আর কেউ তার সঙ্গে থাকে না। সে তখন নিজেই একমাত্র হতে পারে তার ত্রাতা। এত বছর ধরে গোটা পরিবার ওর জন্য যা করে এসেছে তার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কিন্তু আমরা চেয়েছি ব্যাটিং ক্রিজে অন্তত স্পিরিটে ওর সঙ্গে থাকতে। শরীরে যদি বা না-ও থাকতে পারি। ও যেন জানে, পরিবার কখনও ওকে নিঃসঙ্গ থাকতে দেয়নি। সবাই ওর কাছেই আছে।
প্র: সচিনের জীবনে কে বেশি সমস্যা দিয়েছে? টেনিস এলবো না গ্রেগ চ্যাপেল?
অজিত: এ সব প্রশ্ন থাক না।
প্র: থাকবে কেন, আজকের দিনে অন্তত খোলাখুলি বলুন।
অজিত: টেনিস এলবো ওকে দীর্ঘদিন ভুগিয়েছে। ওটা থেকে সেরে ওঠাটা ভয়ঙ্কর কঠিন ছিল। সচিন এই সময় অসম্ভব মনের জোর দেখিয়েছে।
প্র: ১৯ নভেম্বর এলে আপনাদের পারিবারিক জীবনে কী পরিবর্তন আসবে মনে হয়?
অজিত: সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এটাই হবে যে, চব্বিশ বছর পর আর সে ইন্ডিয়া ক্যাপ পরবে না। সচিনও সকালে উঠে ভাববে না গোটা দেশের আনন্দ এনে দেওয়ার অমানুষিক দায়িত্ব আমার ওপর। চিন্তা হবে না কোন কোন বোলারকে পিটিয়ে জেতাতে হবে। মিডিয়ার কাটাছেঁড়া আর প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করবে না ওকে। আর বাটার চিকেনটা বেশি করে খাওয়ার সময় দুশ্চিন্তা তাড়া করে ফিরবে না।
প্র: যেমন অবস্থা থেকে অবিশ্বাস্য উত্থানে সচিন কোটিপতি হয়েছেন, তা তো প্রায় নজিরবিহীন!
অজিত: আমাদের কাছে সচিন একমাত্র তখনই কোটিপতি হিসেবে সম্মান পেয়েছে, যখন ও সেঞ্চুরি করেছে। রান না পেলে ফেরারিতে ঘুরলেই বা কী! তবে এখন শেষ করার সময় গুনে দেখছি একশোটা সেঞ্চুরি, পঞ্চাশ হাজার রান, দুটো বিশ্বকাপে হায়েস্ট স্কোরার। একটাতে সেকেন্ড হায়েস্ট স্কোরার। সচিন মোটেও খারাপ করেনি। ওকে কোটিপতি মানতেই পারি।
প্র: বাবা মারা যাওয়ার পরেও সচিন যে ভাবে নিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপে ফিরে এসেছিলেন, সেটা ভাবাই যায় না। শোনা যায়, আপনারাই নাকি ঠেলে ওঁকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। বিশেষ করে আপনার মা!
অজিত: ফেরত তো পাঠানোরই কথা। মে মাসে যখন বাবার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হল, সচিন শ্রীলঙ্কায়। বাবা তখন অক্সিজেন মাস্ক পরা অবস্থায়। কাছে গিয়ে বললাম, সচিনকে জানাইনি। কাল ও ব্যাট করবে। পরের দিন সেঞ্চুরি করল। বাবাকে এসে জানালাম। উনি ওই অবস্থার মধ্যেই কী খুশি! সচিনের ক্রিকেট ঘিরে বাবার যা দরদ ছিল, মৃত্যু হয়েও যদি পাঁচ মিনিটের জন্য উনি ফেরত আসতেন, ঠিক বলতেন, এ কী! আমার শোকে বাড়িতে বসে আছ কেন? যাও গিয়ে দেশের হয়ে খেলো।
প্র: সচিন দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলেছিলেন। সৌরভরা কাপ জিততে পারেননি কিন্তু সচিনের সে বারের পারফরম্যান্স আজও বন্দিত। সচিন সে বার আনন্দবাজারকে বলেছিলেন, আপনার সঙ্গে বসে তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকান পিচের ব্যাটিং মডেল তৈরি করেছিলেন।
অজিত: সে তো শুধু ওই বিশ্বকাপ কেন, অনবরত আমরা ব্যাটিং নিয়ে কথা বলেছি। প্রত্যেকটা সফরের আগে।
প্র: ক্রিকেট আলোচনাটা কেমন ফ্রিকোয়েন্সিতে হত? বা হয়? সপ্তাহে এক দিন?
অজিত: কার্যত রোজ। রোজই কিছু না কিছু আলোচনা চলে। আর সেটার দরকার হবে না।
প্র: অজিত, আপনাকে কিন্তু শোকার্ত দেখাচ্ছে।
অজিত: না, শোকার্ত কেন? এটাই তো জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম। রিটায়ারমেন্ট তো একদিন না একদিন হওয়ারই ছিল। তবে ওয়াংখেড়েতে গোটা পরিবার যাচ্ছি। চুটিয়ে ওকে শেষ বারের মতো দেখে নিই! |