আর দিন ৬ |
সচিন-আবেগের সেনসেক্সে মুকুট এখন মুম্বইয়ের দখলে |
গৌতম ভট্টাচার্য • মুম্বই |
আবেগের সেনসেক্সে কলকাতার যা আধিপত্য, এক সময় রঞ্জি ট্রফির ওপর মুম্বইয়ের তাই ছিল। আবেগে কলকাতা বরাবর চ্যাম্পিয়ন! কখনও চ্যালেঞ্জার নয়। সোমবার সারা দিনের মুম্বই দেখে মনে হল, এ সপ্তাহের জন্য মুকুটটা হাতবদল হতে যাচ্ছে।
সচিন তেন্ডুলকরকে নিয়ে দিনভর যে পরিমাণ আবেগ, বিশৃঙ্খলা আর ‘মাস হিস্টিরিয়া’ প্রত্যক্ষ করা গেল, তা অবসরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো কোনও মানুষের জন্য কঠিন কর্পোরেট মুম্বই দেখাতে পারে ভাবাই যায়নি।
সকালে সান্তা ক্রুজ বিমানবন্দরে নেমে দেখলাম, সব ক’টা কনভেয়ার বেল্টের ওপরে ক্লোজ সার্কিট টিভিতে সচিনের ম্যাচ। দুপুরে শিবাজি পার্কে বুম লাগিয়ে চ্যানেলওয়ালারা পরের পর ইন্টারভিউ করছেন। সেখানে বিখ্যাত মরাঠা সাংবাদিক তাঁর সাক্ষাৎকারে বলে চলেছেন, “সচিন হল ভারতীয় ব্যাটিংয়ের কার্ল মার্ক্স। মার্ক্সের মতোই আধুনিক মুম্বইয়ের ব্যাটিং ঘরানাটা সচিনের সৃষ্টি।” |
এগিয়ে আসছে মঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার সময়।
সোমবার মুম্বইয়ে এমসিএ-র অনুষ্ঠান শেষে। |
মরাঠার শেষ যুদ্ধে ঘরের শুভেচ্ছা।
এমসিএ-র অনুষ্ঠানে সোমবার।
|
ছবি: উৎপল সরকার। |
|
পাশে দাঁড়ানো এক কোচ সেই মরাঠি সাক্ষাৎকার তর্জমা করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন এই সাংবাদিককে। ইনি দাদার ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত। বললেন, “মার্ক্সের সঙ্গে তুলনাটা ঠিক। সচিন মুম্বই ব্যাটিংয়ের ধারাটাই বদলে দিয়েছে। ভারতের মতো মুম্বই ক্রিকেটের ইতিহাসও দু’ভাগে লেখা উচিত। প্রাক্ সচিন। উত্তর সচিন।” আচরেকরের এক ছাত্রকে কাছাকাছি পাওয়া গেল। যিনি ডুব দিলেন পুরনো স্মৃতিকথায়। বললেন, বিজয় মঞ্জরেকর এক বার শিবাজি পার্ক জিমখানার হয়ে খেলার সময় প্রথম ওভারে একটা স্কোয়ার কাট মিস করেছিলেন। বল কিপারের হাতে চলে যায়। তার পর এক ঘণ্টা আর কোনও স্কোয়ার কাট মারেননি। অমন যে স্কোয়ার কাটে পারদর্শী মঞ্জরেকর, তিনিও কিনা কী করে ঝুঁকিকে প্রথমে নির্মূল করা যায়, তা নিয়ে ভাবতেন। সচিন এসে ধারাটাই বদলে দিয়েছে। কাঙ্গা লিগের তিন নম্বর ম্যাচেই ও প্রথম ওভারে অফস্পিনারকে ছক্কা মেরেছিল। যা দেখে স্লিপে দাঁড়ানো মাধব আপটে বিস্ফারিত হয়ে যান। সিসিআই ক্যাপ্টেন আপ্টে সে দিনই ক্লাবে ফিরে বলেন, আমাদের মেম্বারশিপের নিয়ম ভেঙে এই ছেলেটাকে ক্লাবে ঢোকাতে হবে।
এমনিতে তেন্ডুলকরের বিদায়ী ম্যাচ ঘিরে তাঁর ঘরের মাঠে যা আবহাওয়া, আজ থেকে পঁয়ষট্টি বছর আগে কেনিংটন ওভালে তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। ১৪ থেকে ১৮ অগস্ট হওয়া ওই টেস্টে সবাই সচেতন ছিল ডন শেষ টেস্ট খেলছেন বলে। কিন্তু হিস্টিরিয়া শব্দটা ব্যবহারের সুযোগ কারও হয়নি। অথচ তেন্ডুলকরের জন্য সব কিছুতেই স্ট্যান্ডার্ড হল ব্র্যাডম্যানোচিত। গত কাল যেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাঁকে পরামর্শ দিলেন, ব্র্যাডম্যানের যেমন ক্রিকেট টেকনিক নিয়ে একটা অমর বই রয়েছে আর্ট অব ক্রিকেট। সচিনেরও তেমনই ব্যাটিং টেকনিকের ওপর বই লেখা উচিত। শোনা গেল সচিন প্রস্তাবটা উড়িয়ে দেননি। যাঁরা মনে করেন অবসর জীবনে সচিনের টেকনিক নিয়ে বই লেখা উচিত তাঁদের ব্যাখ্যা হল, ওর ব্যাটিং স্টাইল মোটেই সনাতনী নয়। নীচের হাতটা ভেতরের দিকে ধরে। অর্থাৎ বটম হ্যান্ড খুব বেশি। শোনা যায় দিলীপ সরদেশাই নাকি সচিনের শৈশবে বলেছিলেন, এই গ্রিপে খেললে ছেলেটার কভারে ক্যাচ ওঠা অনিবার্য। এ রকম বহু সরদেশাইকেই সচিন তাঁর নিজস্ব ব্যাটিং স্টাইলে ভুল প্রমাণিত করে ছেড়েছেন। তাঁর বিকল্প ব্যাটিং ধারা থেকে অন্য ঘরানার ব্যাটিং অনুসারীরা যদি আত্মবিশ্বাস পান, সে জন্য তিনি ভবিষ্যতে বই লেখায় হাত দিলে আশ্চর্যের কিছু নেই। |
|
ক্রিকেট-যোদ্ধা। এমসিএ-র তরফে সচিনের হাতে বিশেষ প্রতিকৃতি
তুলে দিচ্ছেন শরদ পওয়ার। সোমবার। ছবি: উৎপল সরকার। |
আশ্চর্য হওয়ার আছে কান্দিভিলিতে এ দিন মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার অনুষ্ঠানে তেন্ডুলকরকে ঘিরে যা প্রত্যক্ষ করলাম। কান্দিভিলি ওভালের এ দিন নামকরণ করা হল সচিন তেন্ডুলকর জিমখানা। বিশাল অনুষ্ঠান হল সেই নামকরণকে ঘিরে। দুটো টিম উপস্থিত। ভারত আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সচিন নিজে উপস্থিত। হাজির মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ। এনসিপি সর্বাধিনায়ক শরদ পওয়ার। এমনকী শিবসেনার মেয়রও। শুরুতে গণপতির নাচ পরিবেশনা করলেন ইশা সর্বাণী, যিনি এক সময় জাহির খানের প্রেমিকা ছিলেন। এর পর অ্যাঙ্কর রবি শাস্ত্রী উঠে ঘোষণা করলেন, সচিন যে হেতু কিশোর কুমারের ভক্ত, তাই কিশোরের চারটে গান তাঁর জন্য গেয়ে শোনাবেন শান। এর পর মঞ্চে এলেন শান। গাইলেন ‘ম্যায় হু ডন’, বললেন, “সচিন তুমিই হলে ব্যাটিংয়ের ডন।” এর পর একে একে গাইলেন ‘তুম সাথ হো যব অপনে দুনিয়া কো দিখা দেঙ্গে।’ শেষ করলেন ‘কভি অলবিদা না কহেনা’ বলে। হাজার পাঁচেক লোকের হাততালি ফেটে পড়ছে। এক এক সময় মনে হচ্ছিল বৃহস্পতিবার থেকে বোধ হয় সচিনের বিয়ে এবং এটা তার আগে সঙ্গীত-এর অনুষ্ঠান হচ্ছে। বা কর্ণ জোহরের ছবি। যাকে তাঁর কোনও কোনও সমালোচকেরা ‘শাদি ভিডিও’ আখ্যা দিয়েছেন। তিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা একসঙ্গে এক মঞ্চে উঠলেন সচিনকে সংবর্ধনা জানাতে। সচিনের সঙ্গে অঞ্জলি, এক দিকে গাওস্কর, এক দিকে ওয়াড়েকর। এত ভিড় যে গাওস্করকে দেখতে পেলাম না, তবে মঞ্চে তাঁর নাম ঘোষণা হয়েছিল। এরই মধ্যে শিবসেনার মেয়র ঘোষণা করে দিলেন যে সচিন প্রথমে মুম্বইকর, তার পরে অন্য কিছু। আবেগের ডেসিবেলে এমন বিস্ফোরণ হল যে সেই হাততালি আর থামতেই চায় না। সচিন যখন বলতে এলেন, তখন এত চিৎকার হচ্ছে যে, কথা শোনার উপায় নেই। স্টেডিয়ামের বাইরে প্রচুর লোক হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে, সচিনের ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে। সেটাও মনে হচ্ছে যেন একটা ফিল্ম। |
|
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সই শিকারিদের চাহিদা মেটাচ্ছেন। ছবি: টুইটার। |
সকালে শুনছিলাম কলকাতার মতো মুম্বইও শুধু সচিন কবে ব্যাটিং করবেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। টেস্টের বাকি দিনগুলো তারা না-ও যেতে পারে। শিবাজি পার্ক আর কান্দিভিলির ছবিটা দেখার পরে
নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না ওয়াংখেড়ে কেমন ব্যবহার করবে। তেত্রিশ হাজার দর্শকাসন ভরিয়ে দেবে? নাকি কলকাতার মতোই অপেক্ষা করে থাকবে কবে সচিনের ব্যাট আসে? ওয়াংখেড়েতে এ দিন অবশ্য টিকিট নিয়ে ব্যাপক ঝামেলা হল। লাইনের টিকিট না পেয়ে উৎসাহীরা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কেনার চেষ্টা করেছিলেন। যে সংস্থার মাধ্যমে কেনার কথা তাদের সার্ভার ডাউন থাকায় সেটাও সম্ভব হয়নি। কমপ্লিমেন্টারিও শোনা যাচ্ছে নাকি সব শেষ। তা নিয়ে জোর বিতর্ক।
সব ব্যাপারে বিতর্কহীন থাকতে চাওয়া সচিন এ দিন সংবর্ধনার উত্তরে আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন, “প্যাভিলিয়নটা আমার নামে দেখে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আমি ক্রিকেট খেলা শুরু করি উনত্রিশ বছর আগে। মুম্বইয়ের হয়ে প্রথম খেলি অনুর্ধ্ব ১৫। স্বপ্নেও কখনও ভাবিনি যে এত বড় মাঠের প্যাভিলিয়নে আমার নাম থাকবে। আমাদের ছোটবেলায় বর্ষাকালে প্র্যাকটিসে ইন্ডোর বলে কোনও বস্তু ছিল না। বর্ষাতেই প্র্যাকটিস করতাম। |
|
এই ওয়াংখেড়েতেই শেষ এবং দুশো টেস্ট। ছবি: উৎপল সরকার। |
তার পর আস্তে আস্তে সব কিছুর অনেক উন্নতি হল। গত কয়েক বছর যখন আমার প্রস্তুতির দরকার হয়েছে, শুধু একটা ফোন করেছি। এমসিএর লোকেরা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমাকে যাঁরা সংবর্ধনা দিচ্ছেন তাঁদের সবিনয়ে বলি, ঠিকঠাক প্রস্তুতি ছাড়া কোনও কিছুই সম্ভব ছিল না। তাই আমি ওঁদের কাছে ভীষণ কৃতজ্ঞ।” শিবসেনার পুরপিতা অবশ্যই চেয়েছিলেন সচিন মরাঠিতে বলুন। কিন্তু মুম্বইকরের তীব্র সেন্টিমেন্ট তিনি কৌশলে পাশ কাটিয়ে গেলেন এই বলে যে, এখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম রয়েছে। ওরা মরাঠি ভাষা বুঝবে না।
সব কিছুই কেমন একটা আজব আর অবিশ্বাস্য চেহারা নিয়েছে। কোনও এক ব্যক্তির জন্য টিম বনাম টিম লড়াইটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া বোধহয় বিশ্বক্রিকেটে আগে কখনও হয়নি। এরই মধ্যে রবি শাস্ত্রী বলছিলেন, “আমার কাছে ইডেন টেস্টের সেরা মুহূর্ত কিন্তু রোহিত শর্মার ড্রাইভ নয়। সামির ইনসুইংও নয়। আমার কাছে ইডেনের সবচেয়ে টানটান করে দেওয়া মুহূর্ত হল যখন ও রকম একটা জঘন্য সিদ্ধান্তের পরও সচিন এক মিনিটের জন্যও কোনও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল না। ভাবাই যায় না জীবনের ১৯৯তম টেস্টে অত খারাপ সিদ্ধান্ত পেয়ে কেউ প্রতিক্রিয়াবিহীন থাকতে পারে। ধন্য এই স্পোর্টসম্যান স্পিরিট! এ জন্যই তেন্ডুলকর!”
|
প্যাভিলিয়নটা আমার নামে দেখে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আমি ক্রিকেট খেলা শুরু করি ঊনত্রিশ বছর আগে। মুম্বইয়ের হয়ে প্রথম খেলি অনূর্ধ্ব ১৫। স্বপ্নেও কখনও ভাবিনি যে এত বড় মাঠের প্যাভিলিয়নে আমার নাম থাকবে।
সচিন তেন্ডুলকর |
|
|
|
টেস্ট ১০ |
ওয়ান ডে ১১ |
রান ৮৪৭ |
রান ৪৫৫ |
সেঞ্চুরি ১ |
সেঞ্চুরি ১ |
সর্বোচ্চ ১৪৮ |
সর্বোচ্চ ১১৪ |
গড় ৪৭.০৫ |
গড় ৪১.৩৬ |
|
|
আপনার মোবাইলে QR Reader ডাউনলোড করে এই QR কোডটি স্ক্যান করুন আর দেখে নিন ওয়াংখেড়ের সচিন বন্দনার প্রস্তুতি। |
|
পুরনো খবর: সচিনকে রঞ্জি চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানাতে চায় মুম্বই
|
|