|
|
|
|
চিরকুন্ডা দুর্ঘটনায় প্রশ্ন সুরক্ষা নিয়েই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • চিরকুন্ডা (ঝাড়খণ্ড) |
বিসিসিএলের বাসন্তীমাতা কোলিয়ারিতে ছাদ ধসে চার জনের মৃত্যুর পরে শোক ছাপিয়ে ক্রমশ খনি-সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্নই বড় হয়ে উঠছে।
মঙ্গলবার দুপুরে কয়লার চাঁই কেটে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার অরূপ চট্টোপাধ্যায়-সহ তিন জনের দেহ বের করা হয়। একটি দেহ সোমবারই পাওয়া গিয়েছিল। জখম হয়ে তিন জন এখনও ধানবাদের হাসপাতালে ভর্তি।
প্রশ্ন উঠছে, যে খনিতে নিরাপত্তার ঘাটতি থাকায় কিছু দিন আগেও উৎপাদন বন্ধ ছিল, সেখানে ফের কয়লা কাটা শুরু হল কেন? যদি বা হল, কতটা সতর্কতা নেওয়া হয়েছিল? যেখানে দু’দিন আগেই ছাদ থেকে গুঁড়ো ঝরতে দেখেছেন শ্রমিকেরা, অরূপবাবু ও অন্য কর্মীরা সেখানে ঢুকলেন কেন? এ রকম ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বজায় রেখে কাজ করার যে নিয়ম, তা কি আদৌ মানা হয়েছিল?
মঙ্গলবার ঝাড়খণ্ডের চিরকুন্ডায় ওই ভূগর্ভস্থ খনি পরিদর্শনে এসে বিসিসিএলের চেয়ারম্যান কাম ম্যানেজিং ডিরেক্টর তাপস লাহিড়ি অবশ্য দাবি করেন, সুরক্ষা ব্যবস্থার কোনও ত্রুটি ছিল না। বোঝার ভুল ছিল। তাঁর কথায়, “প্রাথমিক ভাবে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আমার মনে হয়েছে এটি ‘এরর অফ জাজমেন্ট’।” এই ‘এরর অফ জাজমেন্ট’ তা হলে কার? যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খনির অবস্থা দেখতে নেমেছিলেন, তাঁদের? |
|
কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অরূপবাবুর সহকর্মীরা। ছবি: শৈলেন সরকার। |
বস্তুত, মেদিনীপুরের জঙ্গল থেকে আলিপুরদুয়ার বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে বিস্ফোরণে বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের সদস্যের মৃত্যুর ঘটনাতেও বারবার একই প্রশ্ন উঠেছে। সে সব ঘটনায় নিরাপত্তার নিয়মকানুন ঠিক মতো মানা হয়েছিল, না কি পুলিশকর্মীরা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিলেন, সেই সংশয় এড়ানো যায়নি। খনি দুর্ঘটনা নিয়ে অবশ্য কোনও ব্যাখ্যায় যাননি তাপসবাবু। তিনি শুধু বলেন, “তদন্ত শুরু হয়েছে। পরে বোঝা যাবে।”
বাসন্তীমাতা খনি কয়লা তোলার পক্ষে কতটা সুরক্ষিত, সেই প্রশ্নেরও স্পষ্ট জবাব মেলেনি। সোমবারই কোলিয়ারির প্রজেক্ট ম্যানেজার অশোককুমার সিংহ জানিয়েছিলেন, সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় ২০০৯ সালে ডিরেক্টর জেনারেল মাইন্স সেফটি (ডিজিএমএস) খনি বন্ধ করে দিয়েছিল। মাস ছয়েক আগে আবার তাদের ছাড়পত্র নিয়েই ফের কয়লা তোলা শুরু হয়। অথচ সিএমডি তাপসবাবু দাবি করেন, ডিজিএমএস যে খনির উৎপাদন বন্ধ করেছিল সে ব্যপারে তিনি কিছুই জানেন না। তাঁর বক্তব্য, “সুরক্ষার ত্রুটি ছিল না।”
এ দিনই আবার আসানসোলের সিপিএম সাংসদ তথা খনি ও ইস্পাত বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বংশগোপাল চৌধুরী ঘটনাস্থলে গিয়ে দাবি করেন, “ডিজিএমএস কী ভাবে উৎপাদন শুরু করার ছাড়পত্র দিয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে। খনি আধিকারিকেরাও পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা না করেই এই খনি চালু করেছিলেন।”
সংস্থার ডিরেক্টর (টেকনিক্যাল) অশোক সরকার জানান, দুর্ঘটনার তদন্ত করতে জেনারেল ম্যানেজার (সেফটি) সুরেন্দ্র সিংহের নেতৃত্বে তদন্তকারী দল কাজ শুরু করেছে। ডিজিএমএসের তরফেও পৃথক একটি দল তদন্ত শুরু করছে। অশোকবাবু বলেন, “আমাদের প্রাথমিক ধারণা খনি-সুরক্ষায় ত্রুটি ছিল না। তদন্তে যদি কারও গাফিলতির প্রমাণ মেলে, তার বিরুদ্ধে নিয়মানুগ ব্যবস্থা হবে।”
গত শনিবারই কর্মীরা খনিগর্ভের ছাদ ফেটে গুঁড়ো ঝরতে দেখেছিলেন। ছাদের চাঙড় যে গরম হয়ে গিয়েছে, তা-ও তাঁরা সেই রাতেই কর্তৃপক্ষকে জানান। রবিবার ছুটি ছিল। সোমবার জায়গাটি দেখতে যান অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার অরূপবাবু। সঙ্গে ছিলেন ওভারম্যান সীতারাম মাজি-সহ কয়েক জন। তখনই দুর্ঘটনা ঘটে। প্রশ্ন হল, যেখানে যে কোনও সময়ে চাঁই খসতে পারে, সেখানে ঢুকে পরীক্ষা করতে যাওয়া কি তাঁদের ঠিক হয়েছিল? অন্য কোনও নিরাপদ পদ্ধতি ছিল না?
খনি বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, খনির ছাদে চিড় অনেক সময়ই ধরে। কিন্তু তা ধসে পড়ার ঘটনা বিরল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আগাম ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ওভারম্যান ও মাইনিং সর্দারেরা ছাদে কাঠের লাঠি ঠুকে আঁচ করতে পারেন, চাঁই আলগা হয়ে এসেছে কি না। ছাদ ‘পাংকচার’ (খনির ভাষায়) হয়ে গেলে লোহার তার দিয়ে তা ‘সেলাই’ করে দেওয়া হয়। লোহার খুঁটি লাগিয়ে ধরে রাখা হয় সেই ছাদ। তা সম্ভব না হলে ধসিয়ে দেওয়া হয়। সেই জায়গায় আর কাজ করা যায় না।
ইসিএলের অবসরপ্রাপ্ত ডিরেক্টর (পার্সোনেল) আনন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “চিড় থাকা অবস্থায় পরীক্ষা বা মেরামত করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। খনিকর্মীদের সেই ঝুঁকি নিতেই হয়। ১৯৭৫ সালে চাষনালা কোলিয়ারিতে পরিদর্শনের সময়েই খনির দেওয়াল ফাটিয়ে জল ঢুকে গিয়েছিল। বহু খনিকর্মী মারা যান।” তবে শুধু সুরক্ষা নয়, উদ্ধারপর্ব নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কেননা সোমবার দুপুর থেকে চেষ্টা করেও ধসে পড়া পাথরের চাঁই কেটে তিনটি দেহ বের করতে পারেননি। নিরশা কেন্দ্রের বিধায়ক অরূপ চট্টোপাধ্যায় মদনপুর গ্রাম থেকে ১০ জন পাথর কাটার শ্রমিককে নিয়ে আসেন। তাঁরাই দেহ বের করেন। বিসিসিএল সূত্রে অবশ্য এর ব্যাখ্যা মেলেনি। জানানো হয়েছে, যত দিন তদন্ত চলবে তত দিন খনি বন্ধ থাকবে। যথেষ্ট সুরক্ষা না থাকলে তা পুরোপুরি বন্ধ করেও দেওয়া হতে পারে।
|
|
তারিখ |
স্থান/ মৃত্যুর সংখ্যা |
১৫ অক্টোবর ১৯১০ |
শীতলপুর পশ্চিমবঙ্গ ১২ |
১৪ এপ্রিল ১৯২৩ |
ছিন্দওয়াড়া মধ্যপ্রদেশ ১৫ |
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ |
সোদপুর পশ্চিমবঙ্গ ১৩ |
১২ জুলাই ১৯৫২ |
ধেমো মেন পশ্চিমবঙ্গ ১২ |
১১ এপ্রিল ১৯৬৮ |
পশ্চিম চিরিমিরি মধ্যপ্রদেশ ১৪ |
৯ অগস্ট ১৯৭৫ |
কেসুরগড় বিহার ১১ |
৬ জুলাই ১৯৯৯ |
পরাশকোল পশ্চিমবঙ্গ ৬ |
৩০ নভেম্বর ২০০৬ |
শ্যামসুন্দরপুর পশ্চিমবঙ্গ ৬ |
১১ নভেম্বর ২০১৩ |
চিরকুণ্ডা ঝাড়খণ্ড ৪ |
|
পুরনো খবর: আচমকা ধসে ৪ জনকে চাপা দিল খনির ছাদ |
|
|
|
|
|