|
|
|
|
আচমকা ধসে ৪ জনকে চাপা দিল খনির ছাদ |
সুশান্ত বণিক • চিরকুণ্ডা (ঝাড়খণ্ড) |
দু’দিন আগে থেকেই মাথার ঠিক উপরে কয়লার চাঙড় সাড়া দিচ্ছিল।
‘স্যার, দু’দিন হল খনির চাল থেকে গুঁড়ো ঝরে পড়ছে। এক বার নেমে দেখবেন?’
বহু দিন যাবৎ যে কোনও বিপদে-আপদেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের কাছে ছুটে আসেন বাসন্তীমাতা কয়লা খনির শ্রমিক-কর্মীরা। তিনি নাকি বিপদের আগাম আঁচ পান!
শ্রমিকদের অনুরোধেই সোমবার সকালে পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের চিরকুণ্ডায় পাঞ্চেত রোডের ধারে বাসন্তীমাতা খনিতে নেমেছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার অরূপ চট্টোপাধ্যায়। আচমকা বিকট শব্দে মাথার উপরের জমাট অন্ধকার নীচে নেমে আসে।
যাঁরা ঠিক নীচে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিন জন জখম হলেও বেঁচে গিয়েছেন। বের করা হয়েছে খনিকর্মী হরি লালের (৪৯) দেহ। কিন্তু বছর একান্নর অরূপবাবু, তাঁরই সমবয়সী ওভারম্যান সীতারাম মাজি বা তাঁদের চেয়ে বছরখানেকের ছোট কেবলম্যান লিটু সাহুকে রাত পর্যন্ত কয়লার চাঁইয়ের নীচ থেকে বের করা যায়নি। কয়েক বছর আগে বর্ধমানের অন্ডালেও এ ভাবেই খনির চাল ধসে ছ’জনের মৃত্যু হয়েছিল। |
|
চিরকুণ্ডায় বিসিসিএল-এর ভূগর্ভস্থ খনিতে চাল ধসে পড়ার পরে তখন চলছে উদ্ধারকাজ।
বাইরে জড়ো হয়েছেন আশপাশের বাসিন্দারা। সোমবার ছবি তুলেছেন শৈলেন সরকার। |
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভারত কোকিং কোল লিমিটেডের ১২ নম্বর এরিয়ার এই খনিটিতে যে নিরাপত্তার সমস্যা আছে, তা কিন্তু কর্তৃপক্ষের অজানা ছিল না। খনির প্রজেক্ট ম্যানেজার অশোককুমার সিংহ জানান, নিরাপত্তা সংক্রান্ত ত্রুটি থাকায় মাঝে এক বার কাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল। ডিরেক্টর জেনারেল মাইন্স সেফটি ছাড়পত্র দেওয়ার পরে মাস ছয়েক আগে ফের কাজ শুরু হয়। বিসিসিএলের ডিরেক্টর (টেকনিক্যাল) অশোক সরকার বলেন, “কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল, তার বিভাগীয় তদন্ত হবে। প্রাথমিক ভাবে কোনও কারণ বলা সম্ভব নয়।”
শ্রমিকদের দাবি, শনিবার থেকেই উপরে চাল খসার আওয়াজ পাচ্ছিলেন তাঁরা। পরমেশ্বর সরকার নামে এক শ্রমিকের কথায়, “শনিবার আমি ওই জায়গায় কাজ করতে নেমেছিলাম। খনির চাল থেকে গুঁড়ো পড়তে দেখে তখনই সন্দেহ হয়, চালটি যে কোনও সময় ধসে পড়তে পারে।” রবিবার ছুটির দিন থাকায় কাজ হয়নি।
কোলিয়ারির সিনিয়র ম্যানেজার পান্নালাল দাস জানান, সকালের শিফ্টে দেড়শো জন খনিতে কাজ করতে নেমেছিলেন। সুশীল ইনক্লাইন নামে একটি অংশে নামেন ৮০ জন। বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ যন্ত্র দিয়ে কয়লা কাটার কাজ চলার সময় আচমকা চাল ধসে পড়ে। অশোক সরকারের কথায়, “বাকিরা ছুটে বেরোতে পারলেও চার জন পারেননি।” বিসিসিএল সূত্রের খবর, তিন আহতের মধ্যে এক জনের অবস্থা গুরুতর।
চাল ধসার বিকট শব্দে খনির নীচে তো বটেই, আশপাশের এলাকাতেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খনিকর্মীরা অন্য পথ ধরে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন ছুটে আসেন। দুপুরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখা যায়, কয়েক হাজার মানুষের ভিড়। সকালে যে খনিকর্মীরা নীচে নেমেছিলেন, তখনও তাঁদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
বিজয় নুনিয়া নামে এক শ্রমিকের কথায়, “হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে পিছন ফিরে দেখি, প্রায় একশো ফুট এলাকা জুড়ে অন্তত ২৫ ফুট পুরু কয়লার চাল ধসে পড়েছে। আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠল। মনে হল, সামনের অংশটাও পড়বে। পড়িমরি দৌড় লাগালাম।” খনিগর্ভের অন্য পথ ধরে উপরে উঠে এসেছেন কাজল মাজি। তিনি বলেন, “উঠে শুনি, চার জন চাপা পড়েছেন। জোর ভাগ্য যে বেঁচে গিয়েছি।”
নিজেরা বেঁচে গেলেও শ্রমিক-কর্মী সকলেই কিন্তু বারবার বলছেন অরূপবাবুর কথা। প্রজেক্ট অফিসার অশোক সিংহ বলেন, “অরূপবাবু ভূগর্ভস্থ খনির নাড়িনক্ষত্র জানতেন। তা ছাড়া শ্রমিকদের সঙ্গেও খুব ভাল সম্পর্ক ছিল তাঁর।” খনির কর্মী পরমেশ্বর টান্ডেল বলেন, “শনিবারও তাঁর সঙ্গে খনির পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছিল। কাজ শুরুর আগে তিনি নিজে এক বার দেখতে যেতেন।”
অরূপবাবুর আদিবাড়ি বীরভূমে রামপুরহাটের কুরুম গ্রামে। পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র ছিলেন। পর্বতারোহণ-সহ নানা অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আশির দশকের শেষে গঙ্গাসাগরে নৌকাডুবি হয়ে এক সঙ্গে মারা গিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা। ১৯৯৩ সাল থেকে এই কোলিয়ারিতে কাজের সূত্রে কয়েক কিলোমিটার দূরে এখানেই বিসিসিএল আধিকারিকদের আবাসনে থাকতেন আরূপবাবু। বাড়িতে স্ত্রী ঝিনাই চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও রয়েছে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছোট মেয়ে। বড় মেয়ে দিল্লিতে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতকস্তরে পড়াশোনা করছেন।
সন্ধ্যায় গিয়ে দেখা যায়, আবাসনের সামনে জটলা। ঝিনাইদেবীকে রাত পর্যন্ত খনির চাল ধসার কথা জানানো হয়নি। তিনি জানেন, খনিতে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাঁর স্বামী সেখানে আটকে রয়েছেন। দেরিতে বাড়ি ফিরবেন।
অরূপবাবুর প্রতিবেশী মানিক চট্টোপাধ্যায় ওই খনিতেই কাজ করতেন। অগস্টে অবসর নিয়েছেন। তিনি বলেন, “রবিবারও অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়েছি। অনেক অভিজ্ঞ খনি বিশেষজ্ঞদের থেকেও ওঁর জ্ঞান ছিল বেশি। এ দিন দুপুর ১২টায় খবরটা পেয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছি।”
পার্সোনেল ম্যানেজার এস প্রসন্ন বলেন, “খনির দেওয়াল গরম হওয়া বা জল চুঁইয়ে ঢোকার মতো নানা আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে ডিরেক্টর জেনারেল মাইনস সেফটি খনি বন্ধ করার নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু বাসন্তীমাতা কোলিয়ারির ক্ষেত্রে এমন কোনও নির্দেশ সাম্প্রতিক কালে দেওয়া হয়নি।”
ঘটনাচক্রে, নিরশার বিধায়কের নামও অরূপ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর অভিযোগ, “অধিকাংশ খনিতেই যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে না। সেই কারণেই আজ এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল।” দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন চিড়কুন্ডার মহকুমা শাসক অভিষেক শ্রীবাস্তব। তিনি জানিয়েছেন, কিভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে খনি কর্তৃপক্ষ ও ডিজিএমএসের পাশাপাশি প্রশাসনিক পর্যায়েও তদন্ত করে দেখা হবে। আপাতত এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য প্রশাসন সতর্ক রয়েছে। |
|
|
|
|
|