আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আইনজীবীর সওয়াল থামিয়ে দিলেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বললেন, “আমি কাউকে গুলি করে খুন করিনি। শূন্যে গুলি চালিয়েছি। আমাকে ফাঁসিয়েছে পুলিশ।”
বছর ছত্রিশের মোটাসোটা মহিলা। পরনে নীল টি-শার্ট আর থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট। শর্ট স্ট্রিটে গুলি করে দুই যুবককে খুনের মামলায় মূল অভিযুক্ত মমতা অগ্রবালকে দেখতে ব্যাঙ্কশাল আদালতে তখন উপচে পড়ছে ভিড়।
মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ পুলিশের বড় ভ্যানে লালবাজার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয় মমতাকে। মুখে গামছা জড়ানো অবস্থায় গাড়ি থেকে নামেন তিনি। পুলিশ প্রথমে তাঁকে নিয়ে যায় আদালতের লকআপে। পরে তাঁকে বিচারকক্ষে নিয়ে যান দুই মহিলা পুলিশকর্মী। তখন সেখানে দাঁড়িয়ে মমতার দাদা উমঙ্গ-সহ তিন আত্মীয়। এজলাসের ভিতরে একটি কাঠের বেঞ্চে প্রথমে বসানো হয় মমতাকে। পুলিশি ঘেরাটোপের মধ্যে তাঁর পাশে এসে বসেন আইনজীবী মন্দিরা বসু ও বক্তিয়ার আলম শাহ। ভরা আদালতে পরিচিত আইনজীবীদের দেখতে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মমতা। তাঁদের বলেন, “আমি নির্দোষ। ওরা বোমা, বন্দুক নিয়ে এসেছিল। আমি বাধা না দিলে ওরা আমাকে যৌন নির্যাতন করত।” এর পরেই তাঁকে আনা হয় কাঠগড়ায়।
প্রথমে চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন নিজের পক্ষে দাঁড়ানো আইনজীবীদের সওয়াল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই আইনজীবীদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন সরকার পক্ষের আইনজীবী। সেই বাদানুবাদের সময়েই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সরাসরি বিচারককে নিজের কথা বলতে শুরু করেন মমতা।
মমতার আইনজীবীরা এ দিন আদালতে একই অভিযোগ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ৯-এ শর্ট স্ট্রিটের ওই ১৭ কাঠা জমিটি দখল করার পরিকল্পনা করেছিলেন কয়েক জন। মুম্বইয়ের একটি সংস্থার দিকেও আঙুল তোলেন আইনজীবীরা। ওই সংস্থার আচরণ সন্দেহজনক বলে আদালতে দাবি করেন তাঁরা। মমতার আর এক আইনজীবী সুশান্ত দত্ত আদালতে জানান, ওই সম্পত্তি জোর করে দখল করার জন্যই দুষ্কৃতীরা সোমবার ভোরের আলো ফোটার আগে পাঁচিল টপকে বাড়িটিতে ঢুকেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, মমতার শ্লীলতাহানি করা হয়েছে বলেও আদালতে দাবি করেছেন সুশান্তবাবু।
পুলিশ কমিশনারের বাড়ির এত কাছে ওই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মমতার আইনজীবীরা। মমতার আইনজীবী মন্দিরাদেবী বলেন, “যে ভাবে অস্ত্র হাতে যুবকেরা হামলা চালিয়েছে, তাতে মমতাকে খুন বা ধর্ষণ করাই উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে হচ্ছে।” আইনজীবীদের অভিযোগ, মমতাকে সোমবার সকালে তাঁর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হলেও পুলিশ আদালতে বলেছে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে দুপুরে।
মমতার বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা চালু করার কথা বলেন তাঁর আইনজীবী সুশান্ত দত্ত। সরকার পক্ষের আইনজীবী কৃষ্ণচন্দ্র দাস অবশ্য আদালতে জানান, ঠান্ডা মাথায় ওই খুনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। হতাহত সকলের মাথাতেই বুলেটের আঘাত রয়েছে বলে তিনি এ দিন আদালতে দাবি করেন। পরে বিচারক মমতাকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশে দেন।
আদালতে এ দিন হাজির ছিলেন মমতার দাদা উমঙ্গ অগ্রবাল। ব্যাঙ্ককে পোশাকের ব্যবসায়ী উমঙ্গ ঘটনার খবর পেয়ে এ দিনই কলকাতায় এসেছেন। তিনি বলেন, “সোমবার ভোরে যখন ঘটনাটি ঘটে, তখনই ব্যাঙ্ককে আমাকে ফোন করেছিল মমতা। বলছিল, ওকে প্রাণে মেরে ফেলা হবে। আমি ওকে পুলিশে খবর দিতে বলি। সেই সঙ্গে নিজেও পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলি।” তাঁর অভিযোগ, “নিয়মিত হুমকি-ফোন আসত বোনের কাছে। এমনকী, ভিন্ রাজ্য থেকেও। বর্তমান, প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার, ডিসি (দক্ষিণ), শেক্সপিয়র সরণি থানার ওসি-সহ সকলকে সে কথা জানিয়েছিল বোন। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেননি।”
আদালত কক্ষে দাদার সঙ্গে কথা বলতে না পারলেও পরে লক-আপে সেই সুযোগ পান মমতা। দাদাকে দেখে কাঁদতে থাকেন অঝোরে। যদিও সেই সঙ্গেই জানিয়ে দেন, তিনি হাল ছাড়তে রাজি নন। উমঙ্গও পরে বলেন, “আমি হয়তো তেমন ধনী নই। কিন্তু ওকে এ ভাবে আটকে থাকতে দেব না। আইনের পথে লড়ব শেষ পর্যন্ত। প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হব।” এ দিনও বেশ ক’জন আইনজীবীর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন বলে জানান উমঙ্গ।
|