|
|
|
|
বন্দুক দাগলেন মহিলাও, শহরে জমিযুদ্ধে নিহত ২ |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে কিছু লোককে লক্ষ্য করে বন্দুক চালাচ্ছেন টি-শার্টের উপরে ওড়না জড়ানো এক মহিলা! সঙ্গীদেরও নির্দেশ দিচ্ছেন গুলি চালাতে!
মধ্যপ্রদেশের চম্বল নয়। ঘটনাস্থল খাস কলকাতা! শহরের পুলিশ কমিশনারের বাংলোর পিছনেই।
সোমবার কাকভোরে কলকাতার কেন্দ্রস্থলে, শেক্সপিয়র সরণি থানা-এলাকার শর্ট স্ট্রিটে এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন দুই যুবক। দু’জন আহতও, আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি। পুলিশ জানিয়েছে, নিহতদের নাম প্রসেনজিৎ দে (২৩) ও পিকলু আচার্য (২২)। প্রসেনজিতের বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরে, পিকলু কল্যাণীর গয়েশপুরের বাসিন্দা। দু’জনেই একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার কর্মী। তাঁদের খুন করার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন মমতা অগ্রবাল নামে ওই মহিলা ও তাঁর দুই নিরাপত্তারক্ষী প্রমোদ সাহু ও সফিক আহমেদ ওরফে পাপ্পু। জবরদস্তি অনুপ্রবেশ ও হাঙ্গামা বাধানোর অভিযোগে ধরা হয়েছে তিন মহিলা-সহ আরও ৯ জনকে। এঁদের মধ্যে এক জন আইনজীবী।
শর্ট স্ট্রিটের যে বাড়িটিকে ঘিরে এত কাণ্ড, মমতাদেবী তারই চৌহদ্দিতে থাকা একটি মন্তেসরি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তাঁর বসবাস লাগোয়া অন্য একটি বাড়িতে। যদিও ঘটনার সময়ে তিনি স্কুল-বাড়িতেই ছিলেন। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের দাবি, ১৭ কাঠা জমি-সমেত গড়ে ওঠা বাড়িটি নিয়ে সম্পত্তিগত বিবাদ রয়েছে। এবং তারই জেরে প্রসেনজিৎ, পিকলু-সহ একুশ জনের একটি দল ভোররাতে ওই বাড়িতে ঢুকেছিল, দখল নিতে। তখনই গুলিচালনার ঘটনা ঘটে। |
|
অঙ্কন: সুমন চৌধুরী। |
অদূরে ডিসি (সাউথ)-এর অফিসের সঙ্গে আইপিএস অফিসারদের আবাসন। ভোর সওয়া চারটে নাগাদ গুলির আওয়াজে এক পুলিশ-কর্তার ঘুম ভেঙে যায়। তিনি-ই প্রথম কন্ট্রোলে ফোন করে খবর দেন। প্রায় একই সঙ্গেই আর একটি ফোন থেকে শর্ট স্ট্রিটে গুলিচালনার খবর আসে। ওয়্যারলেসে বার্তা পেয়ে টহলদার ভ্যান পৌঁছে যায় কিছু ক্ষণের মধ্যে। গিয়ে দেখা যায় বাড়ির এক ঘরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন চার যুবক। এক জনের মাথার ঘিলু বেরিয়ে এসেছে। সকলকে এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকেরা দু’জনকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঠিক কী হয়েছিল এ দিন ভোরে?
লালবাজারের খবর: গত সেপ্টেম্বরে ওই বাড়িতে হামলা চালানোর একটি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন মমতা। তখন পুলিশই তাঁকে বাড়ির বাইরে সিসিটিভি-ক্যামেরা বসানোর পরামর্শ দিয়েছিল। আর এ দিন সেই নজরদার-ক্যামেরার ফুটেজ দেখেই পুলিশ ঘটনার ছবি পেয়েছে। কী রকম?
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ভোর সওয়া চারটে নাগাদ শর্ট স্ট্রিটের ওই বাড়ির সামনে তিনটি গাড়ি এসে থামে। তা থেকে নেমে আসে পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে ২১ জন, যাদের মধ্যে ১৮ জন পেশায় বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী (৪ জন পুরুষ সিকিওরিটি গার্ড, ৪ জন মহিলা সিকিওরিটি গার্ড, ও ১০ জন ‘বাউন্সার’)। এ ছাড়া ‘দখলদার’ দলে ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় নামে এক আইনজীবী, তাঁর এক সঙ্গী এবং এক জন ফোটোগ্রাফার। ফুটেজ দেখে পুলিশের অভিযোগ, প্রথমে ধাক্কাধাক্কি করে গেট খোলার চেষ্টা হয়। তাতে কাজ না-হওয়ায় জনা আটেক যুবক পাঁচিল টপকে বাড়ির চত্বরে ঢুকে পড়ে। বাড়ির দুই প্রহরী তখন চত্বরে পার্ক করে রাখা একটি গাড়ির ভিতরে ছিলেন। হানাদারেরা তাঁদের কাছ থেকে গেটের চাবি ছিনিয়ে ফটক খুলে দেয়। দলের বাকিরাও ঢুকে পড়ে। তাদের অনেকের হাতে রড-লাঠিও দেখা গিয়েছে বলে পুলিশের দাবি।
এর পরেই প্রতিরোধ। পুলিশ জানিয়েছে, অনুপ্রবেশকারী এক মহিলা সিকিওরিটি গার্ড বাড়ির ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই মমতা আচমকা বেরিয়ে এসে একনলা স্পোর্টিং গান থেকে গুলি চালান। পাপ্পুও বেরিয়ে আসে দোনলা বন্দুক হাতে। খালি হাতে বেরোয় প্রমোদ। হকচকিয়ে গিয়ে হামলাকারীদের কয়েক জন বাড়ির বাইরে ছুটে পালায়। কয়েক জন ঢুকে পড়ে বাড়ির ভিতরে, বাচ্চাদের স্কুলের একটি ঘরে। পুলিশের দাবি, মমতা তখন পাপ্পুকে গুলি চালাতে নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে নিজের বন্দুক পাপ্পুর হাতে দিয়ে তিনি পাপ্পুর বন্দুকটি নিজের কাছে রাখেন। পাপ্পু গুলি চালায়। বন্দুকবদল-সহ যার পুরোটা সিসিটিভি-ক্যামেরায় স্পষ্ট ধরা পড়েছে বলে পুলিশের দাবি।
কিন্তু কার গুলি কাকে বিদ্ধ করল, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। মন্তেসরি স্কুলের কাঠের ঘরের ভিতরে নিহত ও আহতদের পাওয়া গিয়েছে। ওই ঘরে কোনও সিসিটিভি-ক্যামেরা নেই। পুলিশ জানিয়েছে, প্রত্যক্ষদর্শী তথা পিকলু-প্রসেনজিতের সহকর্মী সুব্রত ঘোষ জেরায় বলেছেন যে, মমতা-পাপ্পু-প্রমোদ মিলে ওই ঘরের মধ্যে প্রথমে তাঁদের কয়েক জনকে মারধর করেন। আর এক প্রত্যক্ষদর্শী, সিকিওরিটি গার্ড ইমরানের কথায়, “মহিলা গুলি চালাতেই আমি একটা টেবিলের তলায় লুকিয়ে পড়ি। পরে ওদের এক জন এসে আমাকে মারধর করে।” ধৃতদের মধ্যে সুব্রত, ইমরানও রয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে বন্দুক দু’টি বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। লালবাজারের খবর, দু’টিরই লাইসেন্স রতনলাল নাহাটার নামে। মিলেছে ২০টি তাজা কাতুর্জ ও সাতটি কার্তুজের খোল। তদন্তকারীদের দাবি, মমতা ও রক্ষীরা দু’টি বন্দুক থেকে প্রায় সাত রাউন্ড গুলি চালিয়েছেন। নিহত দু’জনেরই মাথায় আঘাত।
ঘটনার পরে মমতা অবশ্য নিজের হাতে গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করেন। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির নালিশও এনেছেন তিনি। “আমি দরজা খুললেও বাইরে বেরোইনি। জমি নিয়ে কথা বলতে বলতে বহিরাগতেরা আমার উপরে চড়াও হয়। শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। পাপ্পু ওখানেই ছিল। ও বন্দুক নিয়ে ঘরের বাইরে চলে যায়। গুলির আওয়াজও পাই। পরে শুনেছি, লোক মারা গিয়েছে।” গ্রেফতার হওয়ার আগে বলেছেন মমতা। তবে পুলিশ সিসিটিভি-র ফুটেজে তাঁর এই বক্তব্যের সমর্থন পায়নি। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “ফুটেজে দেখা গিয়েছে, মমতা অগ্রবাল বন্দুক থেকে গুলি ছুড়ছেন।” এক পুলিশকর্তার মন্তব্য, “উনি পাপ্পুর সঙ্গে বন্দুক বদল করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওঁর বসানো সিসিটিভি’র ফুটেজই ওঁকে ধরিয়ে দিল।” |
মমতা অগ্রবাল |
আপনার মোবাইলে QR Reader ডাউনলোড
করে এই QR কোডটি স্ক্যান করুন আর দেখে
নিন অভিযুক্ত মমতা অগ্রবালের প্রতিক্রিয়া। |
|
কিন্তু এমন ঘটনা ঘটল কেন?
পুলিশ সূত্রের ব্যাখ্যা, পুরোটার পিছনে রয়েছে শর্ট স্ট্রিটের মতো অভিজাত এলাকায় ১৭ কাঠা জমি ও বাড়ির মালিকানা-বিবাদ। বাড়িটি বর্তমানে রতনলাল নাহাটা নামে এক ব্যবসায়ীর দখলে, যিনি ওই বাড়িরই বাসিন্দা। কিন্তু ২০১০-এ শিল্পপতি সঞ্জয় সুরেখা পুলিশের কাছে দাবি করেন, জমিটি তিনি মুম্বইয়ের এক সংস্থার কাছ থেকে কিনেছেন। এই পরিস্থিতিতে মালিকানা নিয়ে নিম্ন আদালতে মামলা চলছে। এক পুলিশ-কর্তা বলেন, “রতনবাবু অসুস্থ, শয্যাশায়ী। তিনি বাড়িটার একটা ঘরে থাকেন। তাঁর হয়ে মমতা-ই বাড়ির দেখভাল করছিলেন।” পুলিশ-সূত্রের খবর, গত ১৫ সেপ্টেম্বর তাঁর স্কুলের উপরে হামলা ও বন্দুক চুরির অভিযোগ করেছিলেন মমতা, যদিও তার সত্যতা
প্রমাণিত হয়নি। এ দিনও গ্রেফতার হওয়ার আগে মমতা অভিযোগ করেছেন, সম্পত্তি দখলের জন্য বেশ কয়েক জন তাঁকে ধর্ষণ ও হামলার হুমকি দিচ্ছিল, যে ব্যাপারে পুলিশ কমিশনার থেকে শুরু করে শেক্সপিয়র সরণি থানাকে জানিয়েও তিনি ফল পাননি। মমতার অভিযোগ, সঞ্জয় সুরেখা ও তাঁর দুই সঙ্গী বাড়িটি দখল করতে চান। সঞ্জয়বাবু অবশ্য দাবি করছেন, “ওই ১৭ কাঠা জমি-সম্পত্তির মালিক আমি। জমির নামপত্তনও (মিউটেশন) হয়ে গেছে।”
কিন্তু আইনি পথে না-গিয়ে ভোর রাতে অত জন লোক নিয়ে দখল-অভিযান কেন?
পুলিশের এক সূত্রের ধারণা, পেশাদার নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে ভয় দেখিয়ে সহজে বাড়ির দখল নেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল। প্রসেনজিৎ-পিকলু-সুব্রত-ইমরানদের নিয়োগকারী সংস্থার তরফে অরূপ দেবনাথ অবশ্য বলেন, “জানতাম না যে, কিছুর দখল নেওয়ার জন্য আমার ছেলেদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জানলে ওদের পাঠাতাম না।” কিন্তু কোন কাজের কথা বলে ওই সময়ে ছেলেদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সে সম্পর্কে তিনি খোলসা করে কিছু বলেননি।
পাশাপাশি তদন্তকারী-সূত্রের খবর, আইনজীবী-সহ ওই নিরাপত্তারক্ষীদের কার তরফে শর্ট স্ট্রিটের বাড়িতে পাঠানো হল, এখনও তা পরিষ্কার জানা যায়নি। তবে পুলিশের দাবি, পুরো অভিযানের ছক আগেই কষা হয়েছিল। অরূপবাবুর সংস্থার কয়েক জন গার্ড রবিবার বিকেলে এলাকা ‘রেকি’ করে গিয়েছিল। মমতাদেবীর শ্লীলতাহানির অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কেও পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি। ডিসি (সাউথ) মুরলীধর শর্মা বলেন, “এখনও তেমন কোনও প্রমাণ মেলেনি।”
আর পাঁচ দিনের মতো এ দিনও সাতসকালে মমতা অগ্রবালের খুদে পড়ুয়াদের নিয়ে তাঁর মন্তেসরি স্কুলের বাইরে হাজির হয়েছিলেন অভিভাবকেরা। রক্তের দাগ আর পুলিশের উর্দি দেখে তাঁরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাড়ি যান। |
আট প্রশ্ন |
ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার
হওয়া বন্দুক।—নিজস্ব চিত্র। |
• সম্পত্তির দখল নিতে দল পাঠিয়েছিল কে?
• আইন মেনে বেলিফ আনা হল না কেন?
• এ ব্যাপারে কেন পুলিশকে কিছু জানানো হয়নি?
• সূর্য ওঠার আগেই কেন এই দখল-অভিযান?
• পাঁচিল টপকে অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণ কী?
• দখলদারদের সঙ্গে মমতাদেবীর কি বচসা হয়েছিল?
• তিনি প্রাণ বা সম্পত্তিরক্ষার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হন?
• কোনও আশঙ্কা থেকেই কি বাড়িতে অস্ত্র মজুত? |
|
|
|
|
|
|