লম্বা বারান্দার ধারে পরপর চারটি ঘর নিয়ে স্কুল। লাল, নীল, হলুদ নানা রঙের দেওয়াল। ছোট ছোট রঙিন চেয়ার, দোলনা, ছোট্ট বাস্কেট বলের নেট, গাছ-গাছালির ফাঁকে প্লাস্টিকের তৈরি আপেলের থোকা ঝুলছে এখান-সেখান থেকে। খেলে বেড়াচ্ছে সাদা খরগোশের দল। এর পাশেই বারান্দায় রক্তের টানা দাগ।
মূল দরজায় পুলিশি প্রহরা। ভিতরেও মোতায়েন পুলিশকর্মীরা। ৯এ শর্ট স্ট্রিটের ‘ইয়ং মাইন্ডস স্কুল’-এর দরজা এখন বন্ধ। মঙ্গলবার বাবা-মায়ের হাত ধরে স্কুলে এসে তাই ফিরে যেতে হয় বহু খুদে পড়ুয়াকে।
ওই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বয়স দেড়-দুই থেকে সাড়ে তিন, বড়জোর চার। সকাল ন’টা থেকে ১২টা পর্যন্ত চত্বরটি ভরে থাকে শিশুদের হাসিকান্নায়। প্রতিবেশীরা জানান, পড়ুয়ারা সকলেই বেশ ধনী পরিবারের। প্লে-স্কুল, কিন্ডারগার্টেন ও মন্তেসরি স্কুলটিতে পড়ার খরচ মাসে চার হাজার টাকারও বেশি। স্কুলের অধ্যক্ষা, ধৃত মমতা অগ্রবালের দাদা উমঙ্গের কথায়, “বিভিন্ন দেশের কনস্যুলেটের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ছেলেমেয়েরা পড়ে এখানে। এটি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কোনও পাড়ার স্কুল নয়। বোন নিজের সবটুকু দিয়ে গড়ে তুলেছে এই স্কুলটিকে।” স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মেলিসা ওয়ার্ড নামে এক মার্কিন তরুণী ওই স্কুলটি চালাতে মমতাকে সাহায্য করেন। স্কুলের মূল দরজায় মমতার সঙ্গে মেলিসার নামেরও ফলক আছে।
বছর দেড়েকের ছেলেকে ৩৬ হাজার টাকা দিয়ে ওই প্লে-স্কুলে ভর্তি করেছিলেন মধ্য কলকাতার এক দম্পতি। মঙ্গলবার সেই ছাত্রের মায়ের চিন্তা, স্কুলটা আবার খুলবে তো? বললেন, “স্কুলটা কি বরাবরের জন্য বন্ধ হয়ে গেল? তবে তো বিকল্প ব্যবস্থা করতে হয়।” ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠে সব অভিভাবকের প্রশ্ন এখন এটাই। কিন্তু উত্তর নেই কারও কাছেই। স্থানীয় বাসিন্দা থেকে পড়ুয়াদের অভিভাবক, সকলেই জানাচ্ছেন, স্কুল সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্তই নিতেন মমতাদেবী। তাঁর অনুপস্থিতিতে কে চালাবেন স্কুল, জানেন না কেউ। শর্ট স্ট্রিট এলাকার এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, “কয়েক জন শিক্ষিকা আর আয়া কাজ করেন স্কুলটিতে। মঙ্গলবার অবশ্য তাঁদের আর আসতে দেখিনি। কিন্তু স্কুল চালু রাখার ব্যাপারে তাঁরা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বলে মনে হয় না। মমতাই তো সব করত।”
সেই সর্বেসর্বা অধ্যক্ষা আপাতত পুলিশি হেফাজতে। স্কুলের খুদে পড়ুয়াদের বাবা-মায়েরা তাঁর এই পরিণতির কথা মানতে পারছেন না। মঙ্গলবারও মেয়েকে নিয়ে স্কুলে এসেছিলেন মধ্য কলকাতার এক অভিভাবক। তিনি বলেন, “মমতার মতো নম্র, ভদ্র, পরোপকারী মানুষ কম হয়। পড়ুয়াদের সঙ্গে তো বটেই, অভিভাবকদের সঙ্গেও খুব আন্তরিক ভাবে মিশতেন তিনি।”
দশম শ্রেণি পর্যন্ত মমতা পড়াশোনা করেছেন এপিজে স্কুলে। তার পরে লোরেটো হাউসে ভর্তি হন বলে জানান উমঙ্গ। এপিজের অধ্যক্ষা রীতা চট্টোপাধ্যায় মঙ্গলবার বলেন, “পড়াশোনায় ও বরাবরই ভাল ছিল। আমি নিজে ওকে পড়িয়েছি।” প্রাক্তন ছাত্রীর এ পরিণতিতে বিভ্রান্ত তাঁরাও।
মমতার প্রতিবেশীরা অবশ্য জমি নিয়ে এই গোলমালে যথেষ্টই বিরক্ত। অভিযোগ, জমি নিয়ে মমতার সঙ্গে বিভিন্ন লোকের গোলমাল লেগেই থাকত। এক প্রতিবেশীর কথায়, “আজ এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছে বলে এই স্কুল, তার জমি, মমতা-সহ সব কিছু সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। কিন্তু দিনের পর দিন গণ্ডগোল চলেছে। আমরা বিরক্ত।”
পুলিশ জানিয়েছে, স্কুলটির অনুমোদন সেপ্টেম্বরেই বাতিল হয়ে গিয়েছিল। এমনকী, ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া কাগজপত্রে ওই স্কুলের ঠিকানাও ভুল বলে পুলিশের অভিযোগ। শেক্সপিয়র সরণির একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে স্কুলের নামে যে অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তাতে স্কুলটির ঠিকানা ৯বি শর্ট স্ট্রিট। অর্থাৎ, স্কুল লাগোয়া যে বাড়িতে মমতা থাকতেন, সেটিই স্কুলের ঠিকানা বলে দেখিয়েছেন ব্যাঙ্কে। কেন এমন হল, তার তদন্ত হচ্ছে বলে জানায় পুলিশ। |