এক সময়ে শহরের পাঁচতারা হোটেলে একটি ঘর দু’বছরের জন্য ভাড়া নিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এমন তথ্য জানাচ্ছে পুলিশ।
সমাজের উচ্চ স্তরে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। ঘনিষ্ঠতা ছিল পুলিশ ও রাজনীতির উপরতলার লোকজনের সঙ্গেও। তাঁদের আমোদ-প্রমোদে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করতেন তিনি। তাই সাধারণ দালালের কাজ করা এই ব্যক্তির বাড়ির সামনে এক সময়ে পুলিশি পাহারাও দেখা গিয়েছে।
শর্ট স্ট্রিটে জমি দখলের ঘটনায় কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে উঠে আসছে সত্তর ছুঁইছুঁই এমনই এক ব্যক্তির নাম। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসছে এ সব তথ্য। আপাতত তিনি শয্যাশায়ী, রোগাক্রান্ত ও চলৎশক্তিরহিত। তবু শর্ট স্ট্রিট-কাণ্ডে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের তদন্ত আবর্তিত হচ্ছে তাঁকে ঘিরেই।
তাঁর নাম রতনলাল নাহাটা। পুলিশের বক্তব্য, যে দু’টি বন্দুক থেকে অন্তত সাত রাউন্ড গুলি চলেছে, কেবল সেই দু’টি বন্দুকের লাইসেন্স রতনলালের নামে নেওয়া বলে নয়, ৯-এ শর্ট স্ট্রিটের যে ১৭ কাঠা জমির মালিকানা জটের জেরে এই কাণ্ড, সেই জট পাকিয়েছেন ওই ব্যক্তিই। দশকের পর দশক ধরে যিনি ওই জমিতে বসবাস করছেন। কিন্তু কী অধিকারে ওই জমিতে রতনলালের এই ভাবে গেড়ে বসে থাকা, সেটা ধোঁয়াশা খোদ পুলিশের কাছেও।
তবে, তদন্তে নেমে যে সব বিষয় পুলিশ জেনেছে তা হল, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহিলার সঙ্গে রতনলালের ঘনিষ্ঠতা ছিল। মমতা অগ্রবালের সঙ্গে তাঁর বহুদিনের ঘনিষ্ঠতায় সম্প্রতি চিড় ধরেছিল বলে পুলিশ জেনেছে। তবে কি সোনার খনির মতো ওই জমি দখল নেওয়ার জন্যই রতনলালের সঙ্গে মমতার বিবাদ, এই প্রশ্নই উঠছে।
রতনলালের দাবি, দেড় কোটি টাকা দিয়ে তিন বছর আগে, ২০১০ সালে তিনি ওই জমি কিনে নিয়েছেন জমির আদি মালকিন শৈলবালা সেনের দুই নাতনি রুমি ও রাখীর কাছ থেকে। অথচ, তদন্তকারীরা জেনেছেন, এই জমি তিনিই উদ্যোগী হয়ে মুম্বইয়ে গিয়ে ১৯৯৯ সালে হার্টলাইন এস্টেট নামে একটি সংস্থার নামে রেজিস্ট্রি করে দেন। পুলিশ জানায়, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক ব্যবসায়ীকে শৈলবালা সেনের ‘পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি’ করেছিলেন রতনলাল। তাঁকে নিয়েই সেই সময়ে বিমানে মুম্বইয়ে যান নাহাটা। জুহু বিচের উপরে একটি পাঁচতারা হোটেলে শিবাজীবাবুকে নিয়ে রতনলাল কয়েক দিন ছিলেন। তদন্তকারীরা জেনেছেন, কাগজে-কলমে তখন জমির দাম দেখানো হয়েছিল ১০ লক্ষ টাকারও কম। পুলিশ জেনেছে, মুম্বইয়ে সম্পত্তি ‘রেজিস্ট্রেশন ফি’ সেই সময়ে কলকাতার চেয়ে কম ছিল এবং সে জন্যই কলকাতার জমির রেজিস্ট্রি মুম্বইয়ে গিয়ে করানো হল বলে শিবাজীকে রতনলাল জানিয়েছিলেন। পুলিশ জেনেছে, পরে আবার রতনলাল ওই জমি থেকে ওঠার জন্যই ‘হার্টলাইন’-এর কাছ থেকে ৭৫ লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন।
কিন্তু শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় নামে ওই ব্যবসায়ী কী ভাবে শৈলবালা সেনের পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি হলেন? তদন্তকারীদের বক্তব্য, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা ৯-এ শর্ট স্ট্রিটে রতনলালের কাছে ওই জমির কেয়ারটেকারের কাজ করতেন। সেই সূত্রেই শিবাজীবাবুকে রতনলাল চিনতেন। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়কে ওই জমির উপর সামাজিক অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়ার জন্য একটি বাড়ি তৈরির প্রস্তাবও দেন রতনলাল। সে জন্য তিনি শিবাজীবাবুর কাছ থেকে ১০ লক্ষ টাকা নেন। কিন্তু পরে পুলিশ ও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আপত্তিতে সেখানে অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়ার জন্য বাড়ি তৈরি করা যায়নি। শিবাজীবাবু অবশ্য টাকা ফেরত পাননি। আর রতনলালের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সেখানেই ইতি।
পুলিশ জানায়, বছর তিনেক আগে কলকাতা পুলিশ থেকে শিবাজীকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হয়, ৯-এ শর্ট স্ট্রিটের ওই জমি সত্যিই হার্টলাইন এস্টেট-এর নামে রেজিস্ট্রি করানো হয়েছিল কি না এবং তিনি শৈলবালা সেনের পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি ছিলেন কি না। পুলিশ জেনেছে, সেই সময়ে শিবাজীবাবু গোটা বিষয়টি জানান। শর্ট স্ট্রিট-কাণ্ডের পর লালবাজারের কর্তারা এখন রতনলাল নাহাটার নানা কীর্তিকলাপের কথা জানতে পারছেন।
পুলিশি সূত্রের খবর, শর্ট স্ট্রিটের ওই একই জমি নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে রতনলাল নাহাটাকে ২০১০ সালে গ্রেফতার করা হয়। সেই সময়ে রতনলাল গোটা ৯ শর্ট স্ট্রিটে (এ, বি এবং সি) প্রোমোটারি করার কথা বলে প্রবীর ঘোষ নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৭৬ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন। অভিযোগকারী জানান, জাল উইল দেখিয়ে নিজেকে গোটা ৯ শর্ট স্ট্রিটের মালিক হিসেবে জাহির করেন রতনলাল। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। পরে তিনি জামিনে ছাড়া পান।
শুধু ওই একটি মামলা নয়, রতনলাল নাহাটার নামে পুলিশের খাতায় আরও কিছু অভিযোগ রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর কোটায় মেডিক্যালে আসন পাইয়ে দেওয়ার নাম করে টাকা তোলার অভিযোগও রয়েছে। যার তদন্ত করেছিল সিবিআই। সেই সময়ে সিবিআইয়ের দুর্নীতি দমন শাখার এসপি, বর্তমানে সিআরপিএফের এডিজি বিবেক সহায় বলেন, “বেশ কয়েক বছর আগে ওই মামলায় রতনলাল নাহাটার বিরুদ্ধে আমরা চার্জশিট পেশ করেছিলাম।”
তবে রতনলাল কলকাতার বিভিন্ন থানার ওসি, সাব-ইনস্পেক্টর পদে পোস্টিং-ও করাতেন বলে গোয়েন্দা সূত্রের খবর। সেই রতনলাল দিন কয়েক আগেই হাসপাতাল থেকে ৯-এ শর্ট স্ট্রিটের বাড়িতে ফেরেন।
সোমবার ভোরের ঘটনার পর থেকেই বৃদ্ধ আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রাচীর ঘেরা ওই ১৭ কাঠা জমির মূল প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকেই বাঁ হাতে রয়েছে একটি ঘর। সেখানেই শয্যাশায়ী রতনলাল। ওই দিনের ঘটনার পর থেকেই প্রধান ফটকে তালা আর তার সামনে বসেছে পুলিশি প্রহরা। রতনলালের ঘরের ঠিক সামনেও এখন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। পুলিশি সূত্রের খবর, অসুস্থ রতনলালকে দেখভালের জন্য শুধু তিন পরিচারিকাকে তাঁর ঘরে ঢোকার অনুমতি দিয়েছে পুলিশ। স্থানীয়েরা জানান, এক সময়ে এলাকায় ডাকাবুকো ছিলেন রতনলাল। তবে গত এক বছর তাঁকে কেউ ওই বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেনি। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ জানান, এক বছর ধরে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন রতনলালের বিরুদ্ধে মিছিল করে, স্লোগান তুলে ওই জমির সামনে আসতেন। গণ্ডগোল লেগেই থাকত। তবে প্রতিটি গণ্ডগোলই হত রবিবার।
|