মাথার ভিতরে গুলি আটকে রয়েছে। ওষুধ দিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে তাঁকে। আরও এক দিন না গেলে চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি নিতে পারছেন না।
২১ বছরের কৌশিক আঢ্য এসএসকেএম হাসপাতালে গুরুতর জখম অবস্থায় ভর্তি। শর্ট স্ট্রিটের জমিযুদ্ধে ইতিমধ্যেই প্রাণ গিয়েছে প্রসেনজিৎ দে এবং পিকলু আচার্যর। কৌশিক ওঁদেরই সহকর্মী।
সোমবার রাতেই প্রসেনজিতের দেহ পৌঁছেছে ব্যারাকপুরে রায়বাগানের বাড়িতে, পিকলুর দেহ কল্যাণী গয়েশপুরের বাড়িতে। এ দিন দু’জনের অন্ত্যেষ্টি হয়। দু’টি পরিবারের লোকজন বারবার আক্ষেপ করছিলেন, রবিবার কিছুতেই কাজে যেতে চাননি পিকলুরা। বারবার ফোন করে ওঁদের এক রকম বাধ্য করা হয় যেতে। কোথায় কেন যাচ্ছেন, জানতেনই না কেউ। পিকলুর মা ডলিদেবী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “পুলিশ গোটা বিষয়টাই তদন্ত করুক। দোষীরা যেন সাজা পায়!”
একই অভিযোগ কৌশিকের বাবা কার্তিকবাবুরও। দিশাহারা পিতা মঙ্গলবার বলছিলেন, “বহু নিরাপত্তা সংস্থা রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছে বেআইনি ভাবে। আমাদের মতো গরিব ঘরের ছেলেরা চাকরি না পেয়ে অল্প বয়সে এই পেশায় ঢোকে।” রাতের শিফটেই ডিউটি বেশি, টাকাও বেশি। কিন্তু কোথায় ডিউটিতে নিয়ে যাচ্ছে তা ঠিক মতো জানানোই হয় না। শর্ট স্ট্রিটে কী কাজে যাচ্ছেন, জানতেন না কৌশিকও। কার্তিকবাবুর প্রশ্ন, “কাজ করতে গিয়ে বিপদ হলে কী ভাবে আত্মরক্ষা করবে ওরা? আহত হলে কে-ই বা দেবে চিকিৎসার খরচ? সরকার কেন এই ধরনের সংস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করছে না?” |
প্রসেনজিৎ দে |
পিকলু আচার্য |
কৌশিক আঢ্য |
|
সোমবার শহরের ঘুম ভাঙার আগেই শর্ট স্ট্রিটের ঘটনায় বাঁ চোখে গুলি লাগে বিজয়গড় কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র কৌশিকের। তার পর থেকেই তিনি এসএসকেএম হাসপাতালের নিউ ক্যাজুয়ালটি ব্লকের ২৪ নম্বর শয্যায়। হাসপাতালের স্নায়ু-চিকিৎসক অনুপ চৌধুরী এ দিন জানান, গুলি কৌশিকের খুলির ভিতরে আটকে রয়েছে। বাঁ চোখ ক্ষতবিক্ষত। ৭২ ঘণ্টা না কাটলে ডাক্তারেরা অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি নিতে পারবেন না। তাতে সংক্রমণের আশঙ্কা প্রবল।
হাসপাতালে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ কার্তিকবাবুর, “ডাক্তারবাবু বলছেন, এখন অপারেশন হবে না। এক দিনেই চার হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়েছে। ওর চিকিৎসার খরচ কী করে সামলাব। পাথরের চোখ দরকার হলেও তো কিনতে পারব না!”
চাঁদনি চকের একটি দোকানে সামান্য চাকরি কার্তিকবাবুর। মাস গেলে হাজার চারেক টাকা পান। তাঁর স্ত্রী কণিকাদেবী অসুস্থ। বড় ছেলে কৃষ্ণ একটি সংস্থায় কম্পিউটার অপারেটরের কাজ করেন। কৌশিক ছোট ছেলে। কোনও রকমে সংসার চলে। সোমবার সকালে জয়ন্ত সাহা নামে কৌশিকের সহকর্মী এক বাউন্সার কণিকাদেবীকে ফোন করে কৌশিকের আহত হওয়ার খবর দেন। হৃদ্রোগে আক্রান্ত কণিকাদেবী তার পর থেকে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অভিভাবক ও আত্মীয়েরা জানিয়েছেন, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরেই বাউন্সারের কাজ নিয়েছিলেন কৌশিক। স্বাস্থ্য ভাল ছিল, নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন। তাই কাজ পেতে অসুবিধা হয়নি।
কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থায় কর্মরত বাউন্সার-দের নিজেদের নিরাপত্তা কতটুকু, সেই প্রশ্নই তুলে দিয়েছে শর্ট স্ট্রিট। দুপুরে হাসপাতালে ছেলের পাশে বসে কার্তিকবাবু বলেন, “নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, এমন কাজে পাঠানো হলেও বাউন্সারদের আগে জানানো হয় না। আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রও দেওয়া হয় না।”
পরিণতি? তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেও যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠছেন কৌশিক। চোখের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলার চেষ্টা করছেন। তাই হাত বেঁধে রাখতে হয়েছে। ব্যান্ডেজ ঠিক করতে করতে কার্তিকবাবু বলেন, “একটা চোখ তো নষ্টই হয়ে গেল। কেউ কি আর ওকে বাউন্সারের কাজে রাখবে?”
|