শর্ট স্ট্রিটে গুলি চালানোর ঘটনার পর হাসপাতালে নিজের নিরাপত্তা সংস্থার আহত রক্ষীদের দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। আক্ষেপ করে বলেছিলেন, জোর করে জমি দখলের খবর জানলে কখনওই তাঁর লোকেদের পাঠাতেন না। প্রশ্ন হল, লোক পাঠাতে বলেছিল কে?
উত্তর দেওয়ার জন্য আপাতত কেউ নেই। সোনারপুরের সেই নিরাপত্তা সংস্থার কর্ণধার অরূপ দেবনাথ তদন্ত শুরু হওয়ার পরেই বেপাত্তা হয়ে গিয়েছেন।
সোমবার রাতেই অরূপের খোঁজে সোনারপুরে তাঁর বাড়ি এবং অফিসে তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু পুলিশ পৌঁছনোর আগেই তিনি গা-ঢাকা দেন। তদন্তকারীদের সন্দেহ, নামে নিরাপত্তা সংস্থা হলেও মূলত জোর করে জমি কিংবা সম্পত্তি দখলের কাজেই নিজের সংস্থাকে ব্যবহার করতেন অরূপ। শর্ট স্ট্রিট কাণ্ডেও একই ভাবে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। কাজেই অরূপের কাছেই রহস্যের একটি দিকের চাবিকাঠি রয়েছে বলে গোয়েন্দারা মনে করছেন।
৯এ শর্ট স্ট্রিটের ওই বাড়িতে হামলা চালানোর অভিযোগে ১০ জনকে এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে। মঙ্গলবার জয়ন্ত সাহা নামে অরূপের সংস্থার আরও এক নিরাপত্তারক্ষীকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্তকারীদের দাবি, ধৃতদের অন্যতম, আইনজীবী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জেরায় জানান, সোমবার কার নির্দেশে হামলা চালিয়ে জমির দখল নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল, সে নিয়ে অরূপই সব জানেন। অরূপের মতো পার্থর বাড়িও সোনারপুরে।
প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ জানিয়েছে, অরূপের সংস্থা চার বছরের পুরনো। যদিও ওই সংস্থার নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী বলে কিছু ছিল না। অরূপ নানা জায়গা থেকে প্রয়োজন মতো যুবকদের ভাড়া করতেন। রবিবার রাতে যেমন ডেকে আনেন প্রসেনজিৎ-পিকলু-কৌশিকদের। জেরায় পুলিশ জেনেছে, অরূপের কাছে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করতে ইচ্ছুক কিংবা কাজ করেন, এমন যুবকদের ফোন নম্বর থাকত। বাউন্সার থেকে শুরু করে সাধারণ নিরাপত্তারক্ষী সবই মিলত তাঁর কাছে।
ঘটনার দিন প্রীতম মারিক নামে এক আলোকচিত্রীও ওই দলে ছিলেন। তাঁকেও পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এ দিন আদালতে প্রীতমের মা অপর্ণা মারিক অভিযোগ করেন, তাঁর ছেলেকে অনুষ্ঠানের ছবি তোলার নাম করে ডেকে নিয়ে যান অরূপ। গোয়েন্দারা জেনেছেন, অরূপ এবং পার্থর মধ্যে আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। সোমবার ভোরে পার্থকে সামনে রেখে অরূপই ১৮ জন নিরাপত্তারক্ষীকে ওই বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন বলে তাঁদের ধারণা। নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্যে চার জন মহিলাও ছিলেন।
অরূপ-পার্থর পাশাপাশি তদন্তে উঠে এসেছে ব্যবসায়ী পরাগ মজমুদারের নাম। তদন্তকারীদের দাবি, পার্থ জেরায় বলেছেন, অরূপই তাঁর সঙ্গে পরাগের পরিচয় করিয়ে দেন। ইতিমধ্যেই সঞ্জয় সুরেখা দাবি করেছেন, শর্ট স্ট্রিটের ওই জমি-সম্পত্তি তিনি মুম্বইয়ের একটি সংস্থার মাধ্যমে কিনেছিলেন। পরাগ সেই বেচাকেনায় মধ্যস্থতা করেছিলেন। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, এই ব্যাপারে পরাগকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পরাগ নিজে অবশ্য মঙ্গলবার বলেন, “আমি কিছু জানি না। এ সবের সঙ্গে আমি যুক্ত নই।” সোমবারের ঘটনায় মুম্বইয়ের ওই সংস্থার এক ডিরেক্টরের খোঁজ চলছে। পুলিশ জানিয়েছে, গত ১৫ সেপ্টেম্বর বাড়িটিতে ভাঙচুর করার পরে সেখানে মুম্বইয়ের সংস্থাটির বোর্ডই টাঙিয়ে দিয়েছিল হামলাকারীরা।
সোমবার ভোরের অভিযান পূর্ব-পরিকল্পিত বলেই দাবি তদন্তকারীদের। লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা মঙ্গলবার জানান, ধৃতদের মধ্যে বেশ কয়েক জন স্বীকার করেছে, ঘটনার আগে তারা একাধিক বার ওই এলাকায় ঘুরে গিয়েছে। গেট খোলা না পেলে কী ভাবে তারা বাড়ির ভিতরে ঢুকতে পারবে, তারও আগে থেকে ছক কষা ছিল। সেই পরিকল্পনা হয়েছিল ক্যামাক স্ট্রিট এলাকার একটি আবাসনে।
তবে শর্ট স্ট্রিট কাণ্ডে সামগ্রিক ভাবে থানার ভূমিকা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা জানান। কারণ, ওই জমি নিয়ে যুযুধান দু’পক্ষই পুলিশের একটি অংশের কাছ থেকে নিয়মিত দরকারি খবর পেত বলে মনে করছেন কর্তাদের কেউ কেউ। কয়েকটি ঘটনায় তার আভাস মিলেছে। জমির মালিকানা নিয়ে সঞ্জয় সুরেখার সঙ্গে আইনি লড়াই চলছে যাঁর, সেই রতনলাল নাহাটার একটি লাইসেন্সড পিস্তল ছিল। সম্প্রতি সেটি খোয়া যাওয়ার পরে শেক্সপিয়র সরণি থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। পুলিশ সূত্রের দাবি, হামলাকারীদের কাছে পিস্তল হারানোর খবর ছিল। আবার গুলি চালানোর মূল অভিযোগ যাঁর
বিরুদ্ধে, সেই স্কুল-অধ্যক্ষা মমতা অগ্রবালও পুলিশেরই অন্য একটি অংশের কাছ থেকে আঁচ পেয়েছিলেন যে, রবিবার রাত থেকে সোমবার ভোরের মধ্যে ৯এ শর্ট স্ট্রিটে হামলা চালানো হবে।
মমতার আইনজীবীদের দাবি, শেক্সপিয়র সরণি থানায় বিভিন্ন সময়ে তিনি তিনটি এফআইআর দায়ের করেছিলেন। কিন্তু কোনও বারই থানা ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকী, ১৫ সেপ্টেম্বর তাঁর স্কুলে যে হামলার ঘটনা ঘটেছিল, তা-ও তেমন গুরুত্ব দিয়ে থানা দেখেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। সেই কারণেই থানার ভূমিকা খতিয়ে দেখা হবে বলে লালবাজারের ওই কর্তা জানান। বস্তুত, শর্ট স্ট্রিট কাণ্ডের তদন্ত মঙ্গলবারই শেক্সপিয়র সরণি থানার হাত থেকে নিয়ে গোয়েন্দা বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। তবে পুলিশ জানিয়েছে, স্কুলটির অনুমোদন সেপ্টেম্বরেই বাতিল হয়ে গিয়েছিল। এমনকী ব্যাঙ্কের কাগজপত্রেও স্কুলের যে ঠিকানা দেখানো হয়েছিল, সেটি আসলে মমতার বাড়ির ঠিকানা। প্রতিবেশীরা জানান, জমি নিয়ে রোজকার ঝামেলায় তাঁরা তিতিবিরক্ত।
পুলিশি সূত্রের খবর, হামলাকারীদের পাওয়া তথ্যে একটি ভুল ছিল। তারা জানত, রতনলাল নাহাটার পিস্তলটি খোয়া যাওয়ার পর ওই বাড়িতে আর কোনও আগ্নেয়াস্ত্র নেই। কিন্তু একটি দোনলা বন্দুক ও একটি একনলা স্পোর্টিং গান যে ছিল, সে খবর তারা জানত না। ধৃতদের মধ্যে কেউ কেউ জেরায় গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন, বাড়ি থেকে বন্দুকের গুলি চলতে পারে, এমন আশঙ্কার কথা তাদের আদৌ জানানো হয়নি।
গোয়েন্দাদের সন্দেহ, যে দু’জন নিহত হয়েছেন, তাঁদের বিদ্ধ করেছে দোনলা বন্দুকের গুলি। এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “অকুস্থলে এক জনের মাথার খুলির টুকরো পড়ে ছিল। স্পোর্টিং গানের গুলি লাগলে এমনটা হওয়ার কথা নয়। যা-ই হোক, ব্যালিস্টিক বিশেষজ্ঞরা এই ব্যাপারে শেষ কথা বলবেন।”
মমতা অগ্রবাল ও তাঁর দুই নিরাপত্তারক্ষী পাপ্পু ও প্রমোদকে মঙ্গলবার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হলে বিচারক তাঁদের ২৫ তারিখ পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। জোর করে বাড়িতে ঢুকে হামলা চালানোর অভিযোগে ধৃত ১০ জনকেও এ দিন আদালতে পেশ করা হয়। বিচারক তাঁদের ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন। ধৃতদের মধ্যে তিন জন মহিলা। |