সোনার জমির লোভে মরিয়া সব পক্ষই
তেরো কাঠা জমি তো নয়, সোনার কুমিরছানা!
৯এ শর্ট স্ট্রিটের জমিটিকে কুমিরছানার মতো ব্যবহার করে একাধিক বার বিক্রি এবং একাধিক লোকের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছিল বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, এই খেলার নায়ক যদি হন রতনলাল নাহাটা, তা হলে নায়িকা মমতা অগ্রবাল। পার্শ্বচরিত্রে কখনও পরাগ মজমুদার, কখনও জমির আদত মালকিনের ভাসুরপো আইনজীবী দ্বারকানাথ সেন, কখনও জমি-ব্যবসায়ী দিলীপ দাস!
কী রকম? ১৯৯৯ সালে জমিটি প্রথম বার হাতবদল হয়। জমির মালকিন শৈলবালা সেনের সঙ্গে মুম্বইয়ের ক্রেতা সংস্থা হার্টলাইন এস্টেটের যোগাযোগ করিয়ে দেন রতনলাল। বিনিময়ে দালালির ভাগ পেয়েছিলেন তিনি। হার্টলাইনের কর্তা দিলীপ দাস আসলে রতনলালের বন্ধু। সেই সুবাদেই জমি হাতবদলের পরে কার্যত নিখরচায় ওই জমিতে বসবাস করতে শুরু করেন রতনলাল। একটি রেস্তোরাঁর ব্যবসাও শুরু করেছিলেন কিছু দিন।
রেস্তোরাঁ উঠে যাওয়ার পরে জমি-চিত্রে মমতা অগ্রবালের আবির্ভাব। ওই জমিতে স্কুল খুলে বসেন তিনি। পুলিশের দাবি, রতনলালের ঘনিষ্ঠ ছিলেন মমতা। তবে সম্প্রতি সেই ঘনিষ্ঠতায় চিড় ধরেছিল। জমি নিয়ে দড়ি টানাটানির খেলায় উভয়েই উভয়ের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছিলেন।
শর্ট স্ট্রিটের স্কুলবাড়িতে চলছে তদন্ত। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র।
মমতা এখন পুলিশের হেফাজতে। রতনলালের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, জমিটি দখলে রাখার জন্য ঢাল হিসেবেই স্কুল খুলেছিলেন মমতা। ইতিমধ্যে ২০১০ সালে হার্টলাইনের কাছ থেকে জমিটি কিনে নেন সঞ্জয় সুরেখা নামে এক ব্যবসায়ী। ঘোষিত মূল্য, আট কোটি টাকা। অভিযোগ, এই লেনদেনেও মধ্যস্থতাকারী পরাগ মজমুদারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দালালির ভাগ নেন রতন।
এর পরের পর্বটি ধোঁয়াশার। কারণ, সেই বছরই রতন নিজেই ওই জমি ‘কিনে’ নেন শৈলবালার ভাসুরপো দ্বারকানাথের পরিবারের কাছ থেকে। শৈলবালার বেচে দেওয়া জমি দ্বারকানাথের পরিবারের হাতে গেল কী করে? নথি বলছে, ১৯৯৯ সালে হার্টলাইনকে বেচে দেওয়া জমি ২০০৩ সালে মৃত্যুর আগে উইল করে দ্বারকানাথের দুই মেয়ে রুমি ও রাখীর নামে লিখে দিয়ে যান শৈলবালা। পুলিশের সন্দেহ, রতনলাল-দ্বারকানাথরা সকলে মিলে বৃদ্ধাকে ভুল বুঝিয়ে থাকতে পারে।
দ্বারকানাথ নিজে ১৯৯৯ সালে জমি বিক্রির সময়ে ১০ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন বলে খবর। ফলে জমি হাতবদল হওয়ার কথা তিনি জানতেন না, তা হতে পারে না। আবার রতনলাল নিজে উদ্যোগী হয়ে যে জমি বেচার ব্যবস্থা করলেন, তিনিই আবার সেই জমি কিনতে গেলেন কেন? তবে দ্বারকানাথদের কাছ থেকে জমি ‘কেনার’ সময় মমতার অ্যাকাউন্ট থেকে এক কোটির বেশি টাকা দেওয়া হয়েছিল বলে পুলিশ সূত্রে খবর।
সুতরাং রতনলালের তুখোড় দালালি বুদ্ধি কী ছকে এগোচ্ছিল, সেটা এখনও অজানা। তবে পুলিশের অনুমান, রতনলাল মমতাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ওই জমি শেষমেশ তাঁকেই দেবেন। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ায় মমতা খেপে গিয়েছিলেন। তার উপরে সম্প্রতি স্কুলের লাইসেন্স বাতিল হওয়ায় তিনি আরও সমস্যায় পড়েন। বৃদ্ধ, এখন কার্যত শয্যাশায়ী রতনলালের কাছ থেকে কোনও ভাবে জমিটি আদায় করা বা জমি খালি করার জন্য মমতা বড় অঙ্কের টাকা দাবি করার কথা ভাবছিলেন বলেও পুলিশ সূত্রের দাবি।
দ্বিতীয় পর্যায়ের হাতবদলের পরেই জমি-জট আদালতে পৌঁছয়। সঞ্জয় সুরেখার সংস্থার এক কর্তার দাবি, খাতায়কলমে আট কোটি টাকায় কেনা হলেও জমি খালি করার পরে হার্টলাইনকে আরও ২১ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল। অন্য দিকে দিলীপ দাসের সঙ্গে রতনের চুক্তি হয়েছিল, নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পেলে তিনি জমি ছেড়ে উঠে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে যখন জমি খালি করার সময় এল, রতন বেঁকে বসলেন। দাবি করলেন, জমির মালিক তিনিই। রুমি-রাখীর কাছ থেকে ওই জমি তিনি কিনে নিয়েছেন। দিলীপের সঙ্গে রতনের সুসম্পর্কের এখানেই ইতি। এ দিন দিলীপ দাবি করেন, “রতন এক জন প্রতারক। জমি থেকে উঠে যাওয়ার জন্য টাকা নিয়েও কথার খেলাপ করেছেন।”
রতনের নামে আলিপুর কোর্টে মামলা ঠোকে হার্টলাইন। অভিযোগ, রতন জমি জবরদখল করে রয়েছেন। এই মামলার স্থগিতাদেশ চেয়ে ২০১১ সালে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন রুমি-দ্বারকানাথ-রতনরা। শৈলবালার উইল পেশ করে ওঁরা দাবি করেন, রুমিরাই জমির বৈধ মালিক ছিলেন এবং বৈধ ভাবেই সে জমি তাঁরা রতনকে বেচেছেন। কিন্তু দেখা যায়, সেই উইলের প্রোবেট নেওয়া হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশে হাইকোর্ট ওই উইলের বৈধতা খারিজ করে দেয়। এ বার রতনকে ওই জমি থেকে উচ্ছেদ করার আর্জি নিয়ে গত বছর সঞ্জয় সুরেখা আরও একটি মামলা করেন হাইকোর্টে। তিনটি মামলাই এখনও চলছে। কিন্তু ইতিমধ্যে জমির মিউটেশনের জন্য কলকাতা পুরসভার দ্বারস্থ হয়েছিলেন দু’পক্ষই। পুরসভা সঞ্জয়কেই মিউটেশন দিয়েছে। তার ভিত্তিতেই বাতিল হয়ে গিয়েছে মমতার স্কুলের লাইলেন্স। কিন্তু তিনি মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন।
পুলিশের ধারণা, মমতাকে উচ্ছেদ করতেই দলবল পাঠানো হয়েছিল সোমবার ভোররাতে। মমতা সরে গেলে বিছানায় পড়ে থাকা রতনলালকে সরাতে বেগ পেতে হবে না বলে চক্রী ভেবে থাকতে পারে। খোদ রতনলাল নিজেও অন্যতম চক্রী হয়ে থাকতে পারেন। কোনও সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
পুলিশের মতে আর একটা সম্ভাবনা হল, হার্টলাইনের লোকজনই হয়তো অভিযানের ছক কষেছিল। পুলিশ জেনেছে, সঞ্জয়বাবু সম্প্রতি হার্টলাইনের কাছে আট কোটি টাকা ফেরত চাইতে শুরু করেছিলেন। কেন? পুলিশের একাংশের মতে, জমি খালি করার চাপ বজায় রাখাই সম্ভবত এর উদ্দেশ্য ছিল। সেই চাপের মুখে হার্টলাইন মরিয়া হয়ে দখল অভিযানে নেমে থাকতে পারে। গত মাসে একদল লোক গিয়ে ওই জমির বাইরের পাঁচিলে একটি নোটিস লটকে দিয়েছিল। লেখা ছিল, জমির মালিক হার্টলাইন এস্টেট। কিন্তু সঞ্জয়বাবুকে বিক্রি করা জমি নিজের বলে দাবি করে নোটিস দিল কেন হার্টলাইন? সদুত্তর দিতে পারেননি দিলীপবাবু।
দখল অভিযানের ছক কি সঞ্জয় সুরেখা কষে থাকতে পারেন? সন্দেহ রয়েছে পুলিশের মনে। পুলিশ জানাচ্ছে, সঞ্জয়বাবুই যে ওই জমির মালিক, আদালতে তা ঘোষণা শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই অবস্থায় এত বড় ঝুঁকি সঞ্জয়বাবুর মতো পোড় খাওয়া ব্যবসায়ী নেওয়ার কথা নয়। বরং পুলিশের নজরে রয়েছেন পরাগ মজমুদার। হার্টলাইন সংস্থার কাছ থেকে যখন সঞ্জয়বাবু জমি কেনেন, তখন সেই কেনাবেচার মধ্যস্থতা করেছিলেন পরাগবাবু। পরাগবাবুর দাবি, তার পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি ওই জমির দিকে ফিরেই তাকাননি। অথচ মমতা পুলিশের কাছে অভিযোগে পরাগবাবুর নাম করেছেন। পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে সঞ্জয়বাবু আট কোটি টাকা ফেরত চাওয়ার পরে যাঁরা নড়েচড়ে বসেন, তাঁদের মধ্যে পরাগবাবুও এক জন। সঞ্জয় সুরেখা দাবি করেছেন, জমি খালি করার দায়িত্ব ছিল পরাগের উপরেই। তাই রবিবার রাতের ঘটনার সঙ্গে পরাগের যোগসাজশের সম্ভাবনা পুলিশ উড়িয়ে দিচ্ছে না।
পুলিশ জানিয়েছে, রতনলাল নাহাটা-র সঙ্গে দিলীপ দাসের মতোই পরাগবাবুরও দীর্ঘ দিনের পরিচয়। এই জমি ঘিরেই সেই সম্পর্ক নষ্ট হয়। পুলিশ জানাচ্ছে, ১৯৯৯ সালে শৈলবালা যখন জমিটি হার্টলাইনকে বিক্রি করেন, তখনও সেখানে মধ্যস্থতায় ছিলেন রতনলাল এবং পরাগ। তখনও দু’জনের মধ্যে টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে গণ্ডগোল হয়েছিল, সঞ্জয় সুরেখাকে জমি বেচার সময়েও তার ব্যত্যয় হয়নি।
পরাগবাবুর অভিযোগের আঙুল আবার দ্বারকানাথের দিকে। পরাগের দাবি, ১৯৯৯ সালে জমি বিক্রির সময়ে দ্বারকানাথ ১০ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন। “এর পরে ২০০৩ সালে ওই জমি শৈলবালা যখন দ্বারকানাথের মেয়েদের নামে লিখে দেন, তখন তিনি আপত্তি করলেন না কেন? দ্বারকানাথের দুই মেয়ে যখন সেই জমি রতনলালকে বিক্রি করল, তখনও দ্বারকানাথ ১০ লক্ষ টাকা নিয়েছেন।”
কী বলছেন দ্বারকানাথ? এ দিন মদন মিত্র লেনে তাঁর বাড়িতে গেলে জানানো হয়, স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য তিনি চেন্নাই গিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের কোনও নম্বরও পাওয়া যায়নি।
সতেরো কাঠা জমি নিয়ে কেন এত দড়ি টানাটানি? স্থানীয় প্রোমোটারদের মতে, শর্ট স্ট্রিটের এই জমির দাম এখন কাঠা প্রতি কয়েক কোটি টাকা। আটতলা আধুনিক ফ্ল্যাট-কমপ্লেক্স তুলতে পারলে ৬০ কোটি টাকার উপরে ব্যবসা হওয়ার সম্ভাবনা। যাঁর নামে জমি থাকবে, তাঁর লাভ হবে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা। ফলে পুলিশ একটা বিষয়ে নিশ্চিত বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী না ছাড়ার পণ করে ছিলেন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.