|
|
|
|
আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি |
শঙ্খ ঘোষের কবিতার কিছু লাইন উঠে আসে থিয়েটারের জগতের মতবিরোধ
নিয়ে কথা বলতে বসে। সোহিনি সেনগুপ্ত-এর মুখোমুখি প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
থিয়েটারের জগতে এত মতবিরোধ হয় কেন?
আমি অনেক সময় নিজে বসে বসে ভেবেছি। এই যে বিভিন্ন রকমের মানুষ থিয়েটার করেন, সবাইয়ের মধ্যে সদ্ভাবের অভাব কেন? খুবই ছোট একটা ফ্র্যাটারনিটি। ভেবে দেখেছি যে, আসলে সময়, সমাজ সব কিছু পাল্টে গিয়েছে। আগে গ্রুপ থিয়েটারের কনসেপ্টটা ছিল অন্য রকম। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’র কথা ভাবুন। তখন একটা যৌথ পরিবারের ধারণা ছিল। একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ থাকলে বাড়ির অন্যরা তাকে সাহায্য করত। যেভাবে ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতা তার দাদাকে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এখনকার দিনে মানুষের লাইফস্টাইলটা পাল্টে গিয়েছে। প্রয়োজনটাও পালটেছে। মানি হ্যাজ অলসো বিন ডিভ্যালুড। তখন গ্রুপ থিয়েটার সিস্টেমে এক ভাবে থেকে, সংসার চালিয়ে খানিকটা ত্যাগ স্বীকার করে বাঁচা যেত। ভাল ভাল নাটক হত।
আর এখন?
এখনকার দিনে সব থেকে বড় পরিবর্তনটা হল, যৌথ পরিবারের ব্যাপারটাই আর নেই। বাঁচতে গেলে টাকা লাগে। লাইফস্টাইলের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বেঁচে থাকতে গেলে অন্তত হাজার দশেক টাকা লাগে। থিয়েটারের স্যালারি গ্র্যান্টে যে টাকাটা পাওয়া যেত, সেই অঙ্কটা কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়েনি। ক্রিয়েটিভিটি বেড়েছে। টিকিটের দাম বেড়েছে। কিন্তু গ্রান্ট বাড়েনি। এটা বড় গোলমেলে জায়গায় ফেলেছে মানুষকে। যদি কারও ইচ্ছে থাকে যে সে থিয়েটার করে রেভোলিউশন করবে, তবু তাকে একটা মিনিমাম রোজগার করার কথা ভাবতে হয়। শুধুমাত্র একটা দলে কাজ করে রোজগার করাটা বেশ টাফ। তবে অসম্ভব নয়। তার ফলে কেউ কেউ চাকরি করে। কেউ আবার টেলিভিশনে কাজ করে। কেউ আবার অন্য দলে অভিনয় করে। এ সবই করা যাতে উপার্জনটাও হয়, আবার ক্রিয়েটিভ জায়গার খিদেও মেটে। আগেকার দিনের থেকে এটা একটা বড় পার্থক্য।
আরও কিছু আছে?
থিয়েটারে এখন তিনটে গোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে। বা হয়তো আরও বেশি। তবে আমি প্রধানত এই তিনটে গোষ্ঠীর মানুষের সম্পর্কেই বলছি। এক শ্রেণি হল ‘এ’ গোষ্ঠী। এই সব মানুষ খুব ট্যালেন্টেড আর প্রতিষ্ঠিত। ‘বি’ গোষ্ঠীর মানুষ ট্যালেন্টেড কিন্তু প্রতিষ্ঠিত নন। আর ‘সি’ গোষ্ঠীর মানুষ ট্যালেন্টেডও না, আবার প্রতিষ্ঠিতও নয়। তারা শুধুমাত্র ‘এ’ আর ‘বি’ গোষ্ঠীর আশেপাশে থাকে।
কেন? নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির কারণে?
হতে পারে। এই ‘সি’ গোষ্ঠী কন্সট্যান্টলি ‘এ’ গোষ্ঠীকে মাথায় তোলে। মাথায় তুলে এদেরকে খানিকটা লক্ষ্যভ্রষ্ট করে। |
|
ছবি: কৌশিক সরকার। |
কী ভাবে?
তাদের সামনে রেগুলার পরনিন্দা-পরচর্চা করে। কানভারী করার চেষ্টা করে। তুমি কী ভাল, তুমি কী ভাল বলতে থাকে। যেমন এই যে আমাকে কন্সট্যান্টলি বলতে থাকে আমি নাকি দুর্দান্ত অভিনেত্রী। আমি যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট হই তাহলে আমি মেগালোম্যানিয়াক হয়ে যাব। ‘এ’ আর ‘সি’ গোষ্ঠী কিন্তু এই ‘বি’ গোষ্ঠীর কোনও উন্নতিতে সাহায্য করে না। তার ফলে অনেকের ভিতরে একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছে। যারা ট্যালেন্টেড তারা মনে করছে তাদের পথটাই সঠিক। খানিকটা টেক্কা দেওয়ার খেলা চলতে থাকে। এর ফলে অনেকেই ভুলে যায় যে, এরা সব্বাই মূলত থিয়েটারের জন্য বেঁচে আছে। তাই এত গণ্ডগোল। এই ‘এ’ গোষ্ঠী যেটার আমি একটা অংশ, আমাদের উচিত আমাদের সিনিয়র এবং নিজেদের সঙ্গে বসে আলোচনা করা। যাতে আমরা এই ‘বি’ গোষ্ঠীকে তুলে আনতে পারি। থিয়েটারকে ইকোনমিক্যালি ভায়াবল করতে পারি। নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ না করে এই দিকে মন দেওয়া দরকার। আমাদের মানতেই হবে যে, নিশ্চয়ই সিনিয়রদের থেকে কিছু শেখার আছে। আবার আমাদের পয়েন্ট অব ভিউটাও সিনিয়রদের জানানো দরকার।
সিনিয়র আর জুনিয়রদের মধ্যে এই কথোপকথন কোথায় হওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?
আমি জানি না কেন এটা হয়, তবে এটা ঠিক যে অনেক সময় আমাদের কিছু ভাল না লাগলে, আমরা চুপ করে যাই। কারও ব্যবহার, কথা ভাল না লাগলে আমরা তাকে ডিরেক্টলি গিয়ে বলি না। তা বলি না বলেই আমাদের মতভেদগুলো বাড়তে থাকে। খুব সহজ হত যদি আমরা একটা কমন গোলের দিকে তাকিয়ে এগোতে পারতাম। আর নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারতাম।
অনেক নাট্যকর্মী থিয়েটারে ক্ষমতার হেজিমনি নিয়েও কথা বলেন। নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীকেই বারবার গ্র্যান্ট দেওয়া হচ্ছে বলেই তাদের আক্ষেপ রয়েছে। আপনার বাবা-কে ঘিরে কিছু বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে...
আমি কখনও গ্র্যান্ট কমিটিতে যাইনি। আমার বাবা গিয়েছিলেন। বাবা শুধু নিজের দল নয়, দেশের সবার হয়ে বলেন। এটুকু আমি জানি।
এ রকম কি হতে পারে যে আপনি কিছু জিনিস জানেন না?
(হাসি) এটা বুঝি যে, কেউ কাজ করলে তাকে ঘিরে অনেক বিতর্ক তৈরি হয়। বাবা-র বয়স এখন ৭৮। উনি অ্যাক্টিভলি থিয়েটারটা করেন। তাই এত কন্ট্রোভার্সি। রিটায়ার করলে তো কন্ট্রোভার্সি থাকে না। এ বারের বাজেটে থিয়েটারের কোনও উল্লেখ নেই। সেটা নিয়ে তো কেউ কথা বলে না। সকলের এটা নিয়ে কথা বলা উচিত। এবং একটা কমন গোলকে মাথায় রেখে কাজ করা উচিত। আমার মনে হয় যে, যারা ট্যালেন্টেড এবং প্রতিষ্ঠিত তাদের চেষ্টা করা উচিত কী ভাবে আর একটা প্রজন্মে ভাল ভাল থিয়েটার কর্মী তৈরি করা যায়। যাতে চাকাটা ঘুরতেই থাকে।
অনেকে বলেন যে যারা নান্দীকার ছেড়ে গিয়েছেন, তাঁদের নাকি নান্দীকার স্বীকৃতি দেয় না...
একেবারেই ভুল কথা। নান্দীকার যে আজকে নান্দীকার হয়েছে এটা যে ছেলেটি মাল তোলে, সেট লাগায় থেকে আরম্ভ করে যে বিশাল বড় অভিনেতা সবাইকার জন্যই হয়েছে। নানা কারণে দল থেকে অনেকে আসে-যায়। এটা সব দলে হয়। কে কোথায় কাজ করবে সেটা তো ব্যক্তি মানুষের ওপর ডিপেন্ডেন্ট। |
বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করুন...
|
|
এমন অভিযোগ আছে যে, আপনি খুব একটা অন্যদের থিয়েটার দেখেন না। বা তাদের সে রকম সম্মান করেন না...
এটা একদমই ভুল। স্কুলে আমি ফুলটাইম পড়াই। মাঝেমাঝে সিনেমা করি। থিয়েটার করি। সংসার করি। এত কিছুর মধ্যে আমি চাইলেও সব নাটক দেখে উঠতে পারি না। তবে কারও কাজ অশ্রদ্ধা করি সেটা বলাটা ভুল।
মফসসলে গিয়ে থিয়েটার দেখেন?
আমি ওটা দেখতে পারি না। সেটা নিজের শিডিউলের জন্যই। নান্দীকারে কোনও রবিবার নেই। রবিবার ১০টা থেকে রাত ৮টা অবধি খোলা থাকে। তাই সময় করে উঠতে পারি না। এখন একসঙ্গে চারটে নতুন নাটকের রিহার্স্যাল হচ্ছে।
অন্য কোন দলের নাটক ভাল লাগে আপনার?
অর্পিতা ঘোষ খুব ভাল অভিনেত্রী। দেবেশের ডিরেকশনে নাটক দেখতে পছন্দ করি। দেবেশ, ব্রাত্যদা, দেবশঙ্কর-এর কম্বিনেশনের নাটক আমার পছন্দ। দেবুদার সমস্ত নাটক ভাল লাগে। লালদা (সুমন মুখোপাধ্যায়), মণীশদা, কৌশিকদা (সেন), শ্রীময়ীদির কাজ পছন্দ করি। ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে অণর্র্, তুর্ণা, অনির্বাণ আর অঙ্কিতা খুব ভাল কাজ করছে। আসলে সবার সঙ্গে বড় হয়ে উঠেছি তো। কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলব?
আপনি নিজে তো ‘এ’ গোষ্ঠীর মধ্যে জুনিয়রদের দলে। বাড়িতে কখনও মতবিরোধ হয় না?
এটুকু জানবেন যে, বাবা আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। আবার জীবনের সব থেকে বড় ঝগড়া ওঁর সঙ্গেই হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি যে, সিনিয়রদের উচিত তাঁদের সন্তানদের কান ধরে বলা কখন ভুল করছে। সন্তানদের কর্তব্য বড়দের কাছে সারেন্ডার করা। এটা ভেবে যে তাঁরা আমার মঙ্গল চান।
সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে মতের আদানপ্রদানটা কোথায় হওয়া উচিত?
ইট শ্যুড হ্যাভ বিন ডান ইন আ প্রাইভেট ওয়ে। পাবলিক আর্গুমেন্ট বড় বেদনাদায়ক।
এ নিয়ে আপনি আপনার বাবার সঙ্গে কোনও কথা বলেছেন?
বলেছি।
শেষ কথা কী বলতে চান?
আমার বাবার মতো যাঁরা সিনিয়র, যাঁরা গ্রুপ থিয়েটার করেছেন, তাঁরা নাটকের দলের মানুষদের একটা পরিবার/ সংসারের লোক হিসেবেই দেখে এসেছেন। আসলে কী দরকার জানেন? পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস। ব্রাত্যদার সঙ্গে একবার কথা হচ্ছিল। উনি বলেছিলেন যে ক্রিয়েটিভ লোকেরা খানিকটা স্কিৎজোফ্রেনিক আর ইনসিকিওরড হন। এবং প্রচণ্ড ইমোশনালও। তাই হয়তো অনেকটা স্পর্শকাতর আমি আবারও বলব যে, আমাদের উচিত নতুন জেনারেশনের থিয়েটার কর্মী তৈরি করা এবং কমন গোলের দিকে এগিয়ে যাওয়া। শঙ্খ ঘোষের একটা কবিতার কিছু লাইন আজ মনে পড়ছে:
‘আমরা ভিখারি বারোমাস
পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে
পৃথিবী হয়তো গেছে মরে
আমাদের কথা কে বা জানে
আমরা ফিরছি দোরে দোরে
কিছুই কোথাও যদি নেই
তবু তো ক’জন আছি বাকি
আয় আরও হাতে হাত রেখে
আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।’ |
|
|
|
|
|