বাজারে আলুর জোগান প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এলেও তার মান নিয়ে ক্রেতাদের একাংশের ক্ষোভ বাড়ছে। রাজ্য সরকার অবশ্য খোলা বাজারে সরকারের পাঠানো আলুর মান খারাপ বলে মানতে রাজি নয়। সোমবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে টাস্কফোর্সের বৈঠকের পরে রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এ ব্যাপারে ওঠা অভিযোগ উড়িয়ে বলেন, “ওই আলু পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। মান খারাপ বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা ভিত্তিহীন।”
মুখ্যসচিব এমন দাবি করলেও কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলায় ক্রেতাদের একাংশ কিন্তু সরকারি উদ্যোগে বিক্রি হওয়া আলুর মান নিয়ে সরব। তাঁদের অভিযোগ, সরকারের নির্ধারিত ১৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া আলুর মধ্যে অনেক পচা-গলা আলুও থাকছে। কিন্তু বাজারে ১৫-১৬ টাকা কেজি দরে যে আলু বিক্রি হচ্ছে, তার মান ঠিকঠাক থাকছে। ক্রেতাদের একাংশের প্রশ্ন, হিমঘর থেকে সরকার যদি জ্যোতি আলু বার করিয়ে আনে, তা হলে এত খারাপ আলু আসছে কোথা থেকে? তাঁদের সন্দেহ, সরকারি আলুর বস্তার ক্ষেত্রে জনাকয়েক অসাধু ব্যবসায়ী কিছু ভাল আলুর মধ্যে পচা আলুও মিশিয়ে দিচ্ছেন। ফলে ১৩ টাকা দরে দেড় কেজি আলু কিনলে কাজে লাগার মতো আলু দাঁড়াচ্ছে কমবেশি এক কেজি। হরেদরে যার দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকার কম হচ্ছে না।
আলু ব্যবসায়ীদের একাংশের ব্যাখ্যা অন্য। তাঁদের অভিযোগ, এ জন্য পরোক্ষে দায়ী সরকারই। হিমঘরে দীর্ঘদিন থাকা আলুর একাংশে সামান্য পচন ধরতেই পারে। কারণ, অনেকেই ভাল-খারাপ বাছাই না করে হিমঘরে আলু তোলেন। কিন্তু হিমঘর থেকে বার করার আগে তা ভাল ভাবে বাছাই করা হয়। যে আলু বাজারে পাঠানো হবে, তা আগের দিন রাতে বাতানুকূল ঘর থেকে থেকে বার করে ঢেলে দেওয়া হয় হিমঘরের বারান্দায়। তার পরে পাখা চালিয়ে চলে শুকোনোর পালা। পচা আলুকে এক জায়গায় রাখা হয়, ভাল আলু অন্যত্র সরিয়ে রাখা হয়। এর পরে ভাল আলু বস্তাবন্দি করা হয়। আলু ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, সরকার আলুর দাম নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পরে তাঁদের পক্ষে বাছাই করা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কৃষি বিপণন দফতরের এক কর্তা জানিয়েছেন, মান নিয়ে ক্রেতাদের একাংশের অভিযোগের যথার্থতা বুঝতে আরও দু’-এক দিন সময় লাগবে।
মানের মতো দাম নিয়েও বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। রাজ্যের আলু পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে বলে দাবি করেছেন মুখ্যসচিব। কিন্তু সর্বত্র যে সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি হচ্ছে না, এ দিন উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের ঘটনা তারই প্রমাণ। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, এ দিন পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে বারাসতের শিমুলতলার বাসিন্দা পম্পা বড়ুয়া জানান, স্টেশন সংলগ্ন বড় বাজারে আলুর দাম বেশি নেওয়া হচ্ছিল। প্রতিবাদ করায় তাঁকে ও ছেলে শুভকে হেনস্থা করা হয়। এই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি বলেও তাঁর অভিযোগ।
শুভ বড়ুয়ার অভিযোগ, “বাজারে ১৬ টাকা কেজি দরে জ্যোতি আলু বিক্রি হচ্ছিল। আমরা বলি, মুখ্যমন্ত্রী ১৩ টাকা করে আলু বিক্রির কথা বলেছেন। আপনারা বেশি নিচ্ছেন কেন? এ নিয়েই তর্কাতর্কি বাধে। হঠাৎই দোকানিরা আমার মাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিতে শুরু করে। আমাদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি হয়। এর পরেই কয়েক জন মিলে আমাকে মারধর করে।”
এই পরিস্থিতিতে আলুর সরবরাহ ও সরকার নির্ধারিত দরে আলু কেনাবেচার বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে টাস্কফোর্সের একটি ‘সাব কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। মুখ্যসচিবকে মাথায় রেখে ওই কমিটিতে থাকছেন কৃষিসচিব, ডিজি (এনফোর্সমেন্ট), কলকাতার পুলিশ কমিশনার এবং আলু ব্যবসায়ীরা। মুখ্যসচিব বলেন, “আলুর বাজার অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। তবে কিছু জায়গায় এখনও সমস্যা হচ্ছে। সদ্য গঠিত সাব-কমিটি এখন থেকে আলু সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ই দেখভাল করবে।’’
এ দিনই মুখ্যসচিব জানান, আগে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত হিমঘরে আলু মজুত রাখার মেয়াদ নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। এ দিন টাস্কফোর্সের বৈঠকে বাজারের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে হিমঘরে আলু মজুত রাখার মেয়াদ আরও পনেরো দিন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, যেখানে নতুন আলু ওঠার সময় হয়ে গেল, সেখানে কেন হিমঘরে আলু মজুত রাখার সময়সীমা বাড়াল সরকার? কৃষি দফতরের ব্যাখ্যা, এ বার বন্যা পরিস্থিতির জন্য মূল তিন আলু উৎপাদক জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান ও হুগলিতে আলু চাষ দেরিতে শুরু হয়েছে। ফলে, এ বার রাজ্যের সুপার সিক্স (এস-৬) প্রজাতির আলু বাজারে আসতে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি হয়ে যাবে। তাই আলুর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতেই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
সরকারি ঘোষণায় চিন্তায় পড়েছেন হিমঘর মালিকদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, চাষি বা আলু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁদের আলু রাখার চুক্তি রয়েছে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। সরকার হিমঘরে আলু রাখার মেয়াদ বাড়ানোয় বাড়তি ১৫ দিনের জন্য হিমঘরপিছু তাঁদের অন্তত আড়াই লক্ষ টাকা করে খরচ হবে। এক হিমঘর মালিকের কথায়, “দু’বছর আগে আমরা সরকারি নির্দেশ মেনে অতিরিক্ত এক মাস আলু রেখেছিলাম। সে বাবদ প্রাপ্য টাকা আজও পাইনি। এ বার কী হবে, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছি।” তিনি জানান, অতিরিক্ত দিনগুলির ভাড়া সরকার দেবে না আলু মজুতকারীরা, তা জানতে চেয়ে সংগঠনের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া হবে।
টাস্কফোর্সের বৈঠকে ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানোর উপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা আপাতত বলবৎ থাকবে বলেই ঠিক হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে আগের তুলনায় কিছুটা হলেও নরম হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রশাসনের কর্তারা। মুখ্যসচিবের কথায়, “ভিন্-রাজ্যে আলু পাঠানোর উপরে রাজ্যের নিষেধাজ্ঞা বহালই থাকছে। তবে সরকারের অনুমোদন নিয়ে অন্য রাজ্যে আলু পাঠানো যেতে পারবে।’’ কিন্তু অন্য রাজ্যে আলু না-পাঠানোয় এ রাজ্যে ডিম ও মাছ আসাও তো বন্ধ হয়েছে? জবাবে মুখ্যসচিব বলেন, “আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। আমরা প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলছি।” তিনি জানান, রাজ্যের হিমঘরগুলিতে এই মুহূর্তে ১৩ লক্ষ ৭০ হাজার টন আলু রয়েছে। বাইরের রাজ্যে আলু না-গেলে আরও আড়াই মাস রাজ্যবাসীর চাহিদা মেটানো সম্ভব।
মুখ্যসচিব এ দিন বলেন, “রাজ্যে সাম্প্রতিক আলু সমস্যা তৈরির পিছনে রয়েছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর চক্রান্ত। চার-পাঁচ জন অসাধু আলু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগও পাওয়া গিয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” টাস্ক ফোর্সের এ দিনের বৈঠকে আলু ব্যবসায়ীদের তরফে গুরুপদ সিংহ অভিযোগ করেন, পুলিশের একাংশের মদতে আলুভর্তি ট্রাক ভিন্-রাজ্যে চলে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি খতিয়ে দেখতে রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডিকে নির্দেশ দেন। পরে গুরুপদবাবু বলেন, “আমার কাছে যে খবর পৌঁছেছে, সেটাই আমি বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছি। বলেছি, পুলিশের একাংশের মদতে বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশা সীমান্ত দিয়ে আলু অন্য রাজ্য চলে যাচ্ছে।”
|