আলুর বাজার এ বার স্বাভাবিক হচ্ছে। কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলার বাজারে শনিবার যে পরিমাণ আলুর দেখা মিলেছে, তাতে কিছুটা দামের হেরফের থাকলেও লোকজনকে একেবারে খালি হাতে ফিরতে হয়নি। কৃষি বিপণন দফতরের অফিসারেরা মনে করছেন, মূলত দু’টি কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এক, ভিন্ রাজ্যে আলু রফতানির উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পাশাপাশি সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেই বাজারে বাজারে আলু বেচেছে। ঘাটতি এতে কিছুটা হলেও কমেছে। চাপও বেড়েছে আলু ব্যবসায়ীদের উপর। দুই, সরকার আলু ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দিয়েছে, হিমঘরে যতই আলু মজুত থাকুক, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তা বের করে দিতে হবে। সেই বার্তা পৌঁছেছে হিমঘর মালিকদের কাছেও। ফলে, খুব শীঘ্রই বাজারে আগের দামেই আলু পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন কৃষি বিপণন দফতরের আধিকারিকেরা।
সরকার এই অবস্থান নেওয়ায় ফাঁপরে আলু ব্যবসায়ীদের একাংশ। তাঁরা মনে করছেন, হিমঘরগুলিতে যে পরিমাণ আলু মজুত আছে, তা আগামী ২০ দিনের মধ্যে বের করা সম্ভব নয়। আর তা করতে গেলে প্রচুর আলু নষ্ট হবে। চাষিরা পথে বসবেন। প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির একাধিক সদস্যের বক্তব্য, “হিমঘরগুলিতে এখন ১৬ লক্ষ টন আলু মজুত রয়েছে। প্রতি মাসে রাজ্যে কমবেশি সাড়ে চার লক্ষ টন আলু লাগে। এই যেখানে পরিস্থিতি, সেখানে সরকার চাপ দিয়ে ৩০ তারিখের মধ্যে সব আলু বার করতে বাধ্য করলে অভাবী বিক্রি ছাড়া অন্য পথ থাকবে না।” প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির দাবি, অভাবী বিক্রি ঠেকাতে হিমঘরে মজুত আলু অবিলম্বে ভিন্ রাজ্যে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হোক। না হলে আলু চাষে বিপর্যয় নেমে আসবে। বর্ধমানের আলু ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য সুনীল সাহা বলেন, “এখানকার হিমঘরগুলিতে আড়াই লক্ষ টন আলু মজুত রয়েছে। |
নতুন আলু সাধারণত জানুয়ারির শেষে ওঠে। এ বার দুর্যোগের কারণে নতুন আলু উঠতে ফেব্রুয়ারির শেষ হয়ে যেতে পারে। কারণ এখনও বহু জায়গায় আলু চাষ শুরুই হয়নি।” ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব আলু বার করে দিতে হলে এই তিন মাস চলবে কী করে? প্রশ্ন আলু ব্যবসায়ীদের। বর্ধমানের মতোই পশ্চিম মেদিনীপুরের হিমঘরগুলিতে প্রায় ৬৫ লক্ষ বস্তা আলু মজুত রয়েছে। ওই জেলার আলু ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক বরেন মণ্ডল বলেন, “বীজের জন্য ও দৈনন্দিন ব্যবহার বাবদ আর বড় জোর ১০-১২ লক্ষ বস্তা আলু লাগবে। তার পরেই নতুন আলু উঠে যাবে। বাকি ৫০ লক্ষ বস্তার কী হবে?” মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার অবশ্য এ দিন জানিয়েছেন, এখনই অন্য রাজ্যে আলু পাঠানোর মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। তিনি বলেন, “পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা হচ্ছে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ভবিষ্যতে কী হবে জানা নেই। তবে আলু সঙ্কটের প্রথম রাউন্ডে রাজ্য সরকারেরই জয় হল বলে মনে করা হচ্ছে। তার প্রমাণ মিলেছে হিমঘর মালিকদের কথাতেই। তাঁরা সরকারের ওই সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানিয়েছেন। রাজ্যের হিমঘর মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রামপদ পাল বলেন, “সরকার যথাযথ সিদ্ধান্তই নিয়েছে। প্রতিটি আলুরই নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। ছ’মাস পেরিয়ে গেলে সরকার তা সংরক্ষণের পক্ষে মত দিতে পারে না। এখন হিমঘরগুলিতে যে আলু মজুত আছে, তা ছ’মাস আগের। যদি দেখা যায়, সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে আলু বার করা যাচ্ছে না, তখন সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” ওই সমিতিরই সদস্য নন্দন সেনগুপ্ত বলেন, “৩০ নভেম্বরের পরে হিমঘরে আলু মজুত থাকলে তা আমরা কোল্ড-চেম্বারের বাইরে বার করে দেব।” রাজ্য প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, হিমঘর থেকে আলু বেরোনো শুরু হওয়ায় বাজারে দামও কিছুটা কমেছে। এর ফলে কলকাতার বেশ কিছু বাজারে সরকার যে দামে এত দিন আলু সরবরাহ করছিল, এ দিন তার চেয়ে কম দামেই আলু পেয়েছেন ক্রেতারা। কলকাতা পুরসভার এক পদস্থ কর্তা অবশ্য দাবি করেছেন, “সরকার আলুর দর বেঁধে দেওয়াতেই ফাঁপরে পড়েছেন এক শ্রেণির আড়তদার। ব্যবসা মার খাবে ভেবেই সরকারি দরের চেয়ে কম দামে তাঁরা আলু ছেড়েছেন বাজারে।” তবে শহরের কিছু এলাকায় এ দিনও সরকারের বেঁধে দেওয়া ১৩ টাকার চেয়ে বেশি দামে জ্যোতি আলু বিক্রি হয়েছে বলে অভিযোগ। এ নিয়ে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “ওই অভিযোগ একেবারেই ঠিক নয়। আলুর দর নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।”
|