এর ফলে রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই এ দিন আলুর দেখা মিলেছে। কিন্তু দাম ও মান নিয়ে অশান্তি এড়ানো যায়নি। দেগঙ্গা বাজারে সকালে ১৬-১৮ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছিল। সকাল ৯টা নাগাদ সিঙ্গুরের রতনপুর থেকে তিন লরি আলু এলেও তা বাজারে না ঢুকিয়ে আড়তদারেরা গুদামে নিয়ে যান। খবর ছড়াতেই খুচরো বিক্রেতা এবং ক্রেতাদের মধ্যে আলুর দাম নিয়ে বচসা-হাতাহাতি বেধে যায়। জড়িয়ে পড়েন আড়তদারেরাও। ক্রেতারা দাবি করতে থাকেন, সরকারি দরেই আলু দিতে হবে। খুচরো ব্যবসায়ীরা পাল্টা বলেন, আড়তদারেরা ১৫.৬০ টাকা কেজি দরে আলু দিচ্ছে। তার মধ্যে পচাও থাকছে। কী ভাবে ১৩ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি সম্ভব?
দেগঙ্গার আড়তদার গোপাল সর্দার দাবি করেন, “রতনপুর থেকে আমরা ১৩ টাকা কেজি দরে আলু কিনেছি। এর পরে গাড়ি ভাড়া, গুদাম ভাড়া, আলু নামানোর খরচ তো আছেই।” হুগলি জেলা প্রশাসনের এক কর্তা অবশ্য বলেন, “হিমঘর থেকে আলু বের করার সময়ে সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের বেশি দিতে হচ্ছে, এই অভিযোগ ঠিক নয়। পুলিশি নজরদারি রয়েছে। কিছু লোক বিশেষ উদ্দেশ্যে এই সব রটাচ্ছেন।” বর্ধমান থেকেও জানানো হয়েছে, সমস্ত হিমঘর থেকেই ১০.৫০ টাকা কেজি অর্থাৎ ১০৫০ টাকা কুইন্টাল দরে আলু বিক্রি করা হচ্ছে। দেগঙ্গার আড়তদারেরা পুলিশের কাছে আলু কেনার কোনও রসিদ দেখাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ১৩ টাকা কেজি দরেই তাঁরা আলু বেচতে বাধ্য হন।
কলকাতায় এ দিন আলু পৌঁছয় বেশ বেলা করে। সকাল থেকেই বিভিন্ন বাজারে লম্বা লাইন পড়ে। দক্ষিণ কলকাতায় অধিকাংশ বাজারে সরকারি দরে আলু মিললেও উত্তর ও মধ্য কলকাতায় বেশি সমস্যা হয়। পুরসভার মেয়র পারিষদ (বাজার) তারক সিংহ জানান, তাঁদের গাড়ি মহানগরের ৭৯টি বাজারে প্রায় ২৫৬ মেট্রিক টন আলু সরবরাহ করেছে। কলেজ স্ট্রিট, মানিকতলা, হাতিবাগান, শোভাবাজার, শ্যামবাজারের মতো কয়েকটি বাজারে ১৩ টাকা দরে আলু পাওয়া গেলেও পাড়ার ছোটখাটো দোকানে ১৬ থেকে ২০ টাকা কেজি দরেই আলু বিক্রি হয়েছে। যেখানে সরকারি দরে আলু পাওয়া গিয়েছে, সেখানে আবার বেছে কিনতে দেওয়া হয়নি। এক খুচরো ব্যবসায়ীর কথায়, “আমরা তো বেছে বেছে আলু কিনতে পারছি না। আপনাদের তা হলে বাছতে দেব কী ভাবে?” যাদবপুরের শ্রীকলোনির বাসিন্দা অনিল রায়ের আক্ষেপ, “সমস্ত দোকানে সরকারি দরে আলু ছিল। কিন্তু তার মধ্যে অনেক ফাটা-পচা। তাই আর কিনতে পারলাম না।”
শিলিগুড়িতে আলুর অপ্রতুলতা রুখতে হিমঘরগুলিতে ২৪ ঘণ্টা কড়া নজরদারির নির্দেশ দিয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। তাঁর দাবি, “এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি করছেন। টাস্ক ফোর্স বিষয়টি দেখছে। জলপাইগুড়ির ৬৬টি হিমঘরে আলুর মজুত যথেষ্ট।” দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুচরো ব্যবসায়ীদের আলুর জোগান দিচ্ছে মালদহ জেলা প্রশাসন। কোচবিহারের রায়গঞ্জ, তুফানগঞ্জ, দিনহাটা এবং মাথাভাঙায় ১৩ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি শুরু হয়েছে। বালুরঘাটে অবশ্য অভাব অব্যাহত। অন্য জেলা থেকে লরি ঢোকায় পুরুলিয়ার বাজারেও এ দিন আলুর খরা কেটেছে।
এই পরিস্থিতিতে থেমে নেই রাজনৈতিক তরজাও। উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙায় একটি জনসভায় বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু মন্তব্য করেন, “আলু নিয়ে সরকারের আলুথালু অবস্থা! হিমঘর মালিকদের স্বার্থ দেখতে গিয়েই সরকার সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে।” বন্যা থেকে আলুর ‘নজিরবিহীন সঙ্কট’, সব ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে বৃহস্পতিবার রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরাসরি দায়ী করেছিলেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। এ দিন কামদুনি স্কুলমাঠে পুলিশ আয়োজিত ফুটবলের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে গিয়ে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের পাল্টা তোপ, “সূর্যকান্তবাবু ম্যান মেড বন্যার মতো ম্যান মেড আলু করার চেষ্টা করেছিলেন। ডোজটা কড়া হয়ে গিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী তা সামাল দিয়েছেন।”
বুধবার রাতে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কীটনাশক খেয়ে মৃত্যু হয়েছিল এক আলু ব্যবসায়ীর। আলুর ব্যবসায় ধাক্কা খেয়েই তিনি আত্মহত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ দিন রাজ্য পুলিশের আইজি (আইন-শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা অবশ্য বলেন, “তিন বছর ধরে আলুর ব্যবসায় লাভের মুখ দেখেননি ওই ব্যবসায়ী। মাস দেড়েক ধরে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। পারিবারিক অশান্তিও ছিল।
সেই কারণেই উনি বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন।”
|