বাজারে ফিরল জ্যোতি, তবু স্বস্তি নেই
ভাইফোঁটা থেকে বাজারে প্রায় গায়েব হয়ে গিয়েছিল যে জ্যোতি আলু, সপ্তাহের শেষ দিকে এসে সে ফের মুখ দেখাল। কিন্তু সেই মুখে বেশ কিছু ফাটা-পচা থাকায় অনেকেরই মনে ধরল না। পাশাপাশি দাম নিয়ে অশান্তিও এড়ানো গেল না।
রাজ্য সরকারের চাপে বড় বাজারগুলিতে আলুর দাম নাগালে এলেও ছোট-ছোট বাজারে অবশ্য এখনও তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। বেশি দামে আলু বিক্রি হওয়ায় শুক্রবার উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গায় গোলমাল বাধে। শেষ পর্যন্ত সেখানকার ব্যবসায়ীরা সরকারের বেঁধে দেওয়া ১৩ টাকা কেজি দরেই জ্যোতি আলু বেচতে বাধ্য হন। কিন্তু তাতেও সমস্যা মিটছে কই? যেখানেই সরকারের বেঁধে দেওয়া দরে আলু মিলেছে, সেখানেই অবধারিত ভাবে প্রশ্ন উঠেছে মান নিয়ে। ভাল আলু কিনতে কেজি প্রতি ১৬ থেকে ২০ টাকা খরচ করতে হয়েছে অনেককেই। আর বেশি দামের চন্দ্রমুখী আলু তো কার্যত উধাও!
বাজারে আলুর জোগান ঠিক রাখতে গত কয়েক দিন ধরেই হিমঘর ও ব্যবসায়ীদের উপরে চাপ বাড়াচ্ছে সরকার। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে হিমঘর থেকে সব আলু বের করে দিতে হবে বলে বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে। দুই প্রধান আলু উৎপাদক জেলা বর্ধমান ও হুগলি থেকে এ দিন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর আলু পাঠানো হয়। বর্ধমানের কৃষি বিপণন দফতরের হিসেবে, সেখানে শ’খানেক হিমঘরে এখনও প্রায় আড়াই লক্ষ মেট্রিক টন আলু মজুত রয়েছে। এ দিন কলকাতায় ১২ ট্রাক এবং আসানসোল ও দুর্গাপুরে ৬ ট্রাক করে আলু পাঠানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার শুধু কলকাতাতেই ২৮ ট্রাক আলু পাঠানো হয়। হুগলির হিমঘর থেকে বেরিয়েছে লাখখানেক আলুর প্যাকেট (৫০ কেজির)। শুধু সিঙ্গুর থেকেই পাঠানো হয় প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার প্যাকেট। বাঁকুড়া, বীরভূম ও জলপাইগুড়ির হিমঘর থেকেও আলু বেরিয়েছে।

মনোহর পুকুর রোডে ১৩ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রির ব্যবস্থা করেছে রাজ্য।
সেখানে নামানো হচ্ছে আলুর বস্তা। শুক্রবার। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
এর ফলে রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই এ দিন আলুর দেখা মিলেছে। কিন্তু দাম ও মান নিয়ে অশান্তি এড়ানো যায়নি। দেগঙ্গা বাজারে সকালে ১৬-১৮ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছিল। সকাল ৯টা নাগাদ সিঙ্গুরের রতনপুর থেকে তিন লরি আলু এলেও তা বাজারে না ঢুকিয়ে আড়তদারেরা গুদামে নিয়ে যান। খবর ছড়াতেই খুচরো বিক্রেতা এবং ক্রেতাদের মধ্যে আলুর দাম নিয়ে বচসা-হাতাহাতি বেধে যায়। জড়িয়ে পড়েন আড়তদারেরাও। ক্রেতারা দাবি করতে থাকেন, সরকারি দরেই আলু দিতে হবে। খুচরো ব্যবসায়ীরা পাল্টা বলেন, আড়তদারেরা ১৫.৬০ টাকা কেজি দরে আলু দিচ্ছে। তার মধ্যে পচাও থাকছে। কী ভাবে ১৩ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি সম্ভব?
দেগঙ্গার আড়তদার গোপাল সর্দার দাবি করেন, “রতনপুর থেকে আমরা ১৩ টাকা কেজি দরে আলু কিনেছি। এর পরে গাড়ি ভাড়া, গুদাম ভাড়া, আলু নামানোর খরচ তো আছেই।” হুগলি জেলা প্রশাসনের এক কর্তা অবশ্য বলেন, “হিমঘর থেকে আলু বের করার সময়ে সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের বেশি দিতে হচ্ছে, এই অভিযোগ ঠিক নয়। পুলিশি নজরদারি রয়েছে। কিছু লোক বিশেষ উদ্দেশ্যে এই সব রটাচ্ছেন।” বর্ধমান থেকেও জানানো হয়েছে, সমস্ত হিমঘর থেকেই ১০.৫০ টাকা কেজি অর্থাৎ ১০৫০ টাকা কুইন্টাল দরে আলু বিক্রি করা হচ্ছে। দেগঙ্গার আড়তদারেরা পুলিশের কাছে আলু কেনার কোনও রসিদ দেখাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ১৩ টাকা কেজি দরেই তাঁরা আলু বেচতে বাধ্য হন।
কলকাতায় এ দিন আলু পৌঁছয় বেশ বেলা করে। সকাল থেকেই বিভিন্ন বাজারে লম্বা লাইন পড়ে। দক্ষিণ কলকাতায় অধিকাংশ বাজারে সরকারি দরে আলু মিললেও উত্তর ও মধ্য কলকাতায় বেশি সমস্যা হয়। পুরসভার মেয়র পারিষদ (বাজার) তারক সিংহ জানান, তাঁদের গাড়ি মহানগরের ৭৯টি বাজারে প্রায় ২৫৬ মেট্রিক টন আলু সরবরাহ করেছে। কলেজ স্ট্রিট, মানিকতলা, হাতিবাগান, শোভাবাজার, শ্যামবাজারের মতো কয়েকটি বাজারে ১৩ টাকা দরে আলু পাওয়া গেলেও পাড়ার ছোটখাটো দোকানে ১৬ থেকে ২০ টাকা কেজি দরেই আলু বিক্রি হয়েছে। যেখানে সরকারি দরে আলু পাওয়া গিয়েছে, সেখানে আবার বেছে কিনতে দেওয়া হয়নি। এক খুচরো ব্যবসায়ীর কথায়, “আমরা তো বেছে বেছে আলু কিনতে পারছি না। আপনাদের তা হলে বাছতে দেব কী ভাবে?” যাদবপুরের শ্রীকলোনির বাসিন্দা অনিল রায়ের আক্ষেপ, “সমস্ত দোকানে সরকারি দরে আলু ছিল। কিন্তু তার মধ্যে অনেক ফাটা-পচা। তাই আর কিনতে পারলাম না।”
শিলিগুড়িতে আলুর অপ্রতুলতা রুখতে হিমঘরগুলিতে ২৪ ঘণ্টা কড়া নজরদারির নির্দেশ দিয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। তাঁর দাবি, “এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি করছেন। টাস্ক ফোর্স বিষয়টি দেখছে। জলপাইগুড়ির ৬৬টি হিমঘরে আলুর মজুত যথেষ্ট।” দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুচরো ব্যবসায়ীদের আলুর জোগান দিচ্ছে মালদহ জেলা প্রশাসন। কোচবিহারের রায়গঞ্জ, তুফানগঞ্জ, দিনহাটা এবং মাথাভাঙায় ১৩ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি শুরু হয়েছে। বালুরঘাটে অবশ্য অভাব অব্যাহত। অন্য জেলা থেকে লরি ঢোকায় পুরুলিয়ার বাজারেও এ দিন আলুর খরা কেটেছে।
এই পরিস্থিতিতে থেমে নেই রাজনৈতিক তরজাও। উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙায় একটি জনসভায় বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু মন্তব্য করেন, “আলু নিয়ে সরকারের আলুথালু অবস্থা! হিমঘর মালিকদের স্বার্থ দেখতে গিয়েই সরকার সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে।” বন্যা থেকে আলুর ‘নজিরবিহীন সঙ্কট’, সব ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে বৃহস্পতিবার রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরাসরি দায়ী করেছিলেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। এ দিন কামদুনি স্কুলমাঠে পুলিশ আয়োজিত ফুটবলের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে গিয়ে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের পাল্টা তোপ, “সূর্যকান্তবাবু ম্যান মেড বন্যার মতো ম্যান মেড আলু করার চেষ্টা করেছিলেন। ডোজটা কড়া হয়ে গিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী তা সামাল দিয়েছেন।”
বুধবার রাতে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কীটনাশক খেয়ে মৃত্যু হয়েছিল এক আলু ব্যবসায়ীর। আলুর ব্যবসায় ধাক্কা খেয়েই তিনি আত্মহত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ দিন রাজ্য পুলিশের আইজি (আইন-শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা অবশ্য বলেন, “তিন বছর ধরে আলুর ব্যবসায় লাভের মুখ দেখেননি ওই ব্যবসায়ী। মাস দেড়েক ধরে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। পারিবারিক অশান্তিও ছিল।
সেই কারণেই উনি বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন।”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.