বড় সংশয়ে রয়েছেন নবকৃষ্ণ মণ্ডল। প্রায় পৌনে পাঁচ বিঘা আবাদি জমি তাঁর। হুগলির নারায়ণপুরের সম্বৎসরের সবুজ ধানি জমিতে বছরে দু’টো ফলন তাঁর বাঁধা। সঙ্গে, শীত কিংবা প্রাক-বর্ষায় সব্জি-আনাজের ভরা খেত দেখে নিজেরই চোখ জুড়িয়ে যেত তাঁর।
সেই ‘সোনা-জমির’ মাটি বেচে বছর কয়েক বাড়তি আয়ের পরে গত দু-বছর ধরে ফলন তাঁর বড্ড মার খাচ্ছে। অথচ হেমন্তের গোড়ায় কালী পুজো শেষে উৎসবের মরসুম ফুরিয়ে যেতেই ইট ভাটার কারবারিরা ফের এসে হত্যে দিয়ে পড়েছে। অনেক সময়ে অনুরোধ তা বদলে যাচ্ছে আদেশে। নবকৃষ্ণ বলেন, “কী যে করি! মাটি বেচে বাড়তি একটা আয় হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু সেই সোনা জমির উর্বরতা যেন পড়ে গিয়েছে। ফসলের সেই জেল্লা হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।”
মাটি মাফিয়াদের ইটভাটায় মাটি বেচার ফাঁদে কি এ বারও পা দেবেন তিনি?
ধন্দটা তাঁর একার নয়। হুগলির হরিপাল, শিয়াখালা, জিরাট, তারকেশ্বর এমনকী ক্রমেই জনবসতে ঢেকে যাওয়া চন্দননগর, উত্তরপাড়ার লাগোয়া এলাকাতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমনই অজস্র কৃষিজীবী মানুষ এখন এমনই দ্বিধায়, ইটভাটায় মাটি বেচা কি ঠিক হবে?
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর দক্ষিণবঙ্গ থেকে প্রায় সাড়ে সাতশো কোটি কেজি মাটি নিশ্চুপে ট্রাক-বন্দি হয়ে পাড়ি দিচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন ইটভাটায়। |
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যে অন্তত ১৫০০ ইটভাটা চালু রয়েছে যাদের কাঁচামাল কৃষিজমির মাটি। প্রতিটি ইটভাটায় বছরে অন্তত ১০ লক্ষ ইট তৈরি হয়। এবং প্রতিটি ইটের জন্য প্রয়োজন প্রায় ৫ কেজি মাটি। অর্থাৎ হিসেব অনুযায়ী বছরে কৃষি জমি থেকে অন্তত সাড়ে সাতশো কেজি মাটি হারিয়ে যাচ্ছে ইটভাটার আগুনে।
যা শুনে কৃষিবিদদের কপালে ভাঁজ পড়েছে। কেন? ব্যাখ্যাটা দিলেন কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের বিজ্ঞানী এস এল সুন্দারাইয়া। তিনি বলেন, “জমির ‘টপ সয়েল’ বা উপরের আড়াই থেকে চার ফুটের মধ্যেই মাটির অধিকাংশ গুণাগুন থাকে। আর মাটির ওই উপরি ভাগটাই কেটে নিয়ে যায় ইটভাটাগুলি। ক্রমান্বয়ে এটা চলতে থাকায় কোথাও সাত কোথাও বা দশ বছরের মধ্যেই মাটি তার উর্বরা শক্তি হারাতে শুরু করেছে। ফলনেও তার প্রভাব পড়ছে।” এ ভাবে চললে যে অচিরেই পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ কৃষি জমিতে ফলন শিকেয় উঠবে সে ব্যাপারে রাজ্যের কৃষি দফতরকে সতর্কও করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটক ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে পরিবেশ দফতর এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে সতর্ক করেছেন বলে জানা গিয়েছে।
গত কয়েক বছরে শুধু হুগলি নয়, লাগোয়া হাওড়া, নদিয়া, এমনকী দুই চব্বিশ পরগনা জেলা জুড়েও বহু আবাদি জমির মালিক তাঁদের জমির উর্বরতা খুইয়ে আদতে হারিয়েছেন তাঁদের জমির ফলন। তাঁদের চেনা নয়নমণি, আইআর-৬৪ কিংবা মিনিকেটের মতো ধান সেচের পর্যাপ্ত জল, উঁচু মানের সার পেয়েও কেমন জৌলুষ হারিয়েছে।
হরিপালের চাষি সুকুমার হালদার বলছেন, “ধানের রংটাই কেমন বদলে গিয়েছে। চালের দানার আকারও ছোট।” নদিয়ার ধুবুলিয়ার কুদ্দুস শেখ বলেন, “ইটভাটার জন্য ক্রমাগত মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ায় জমি কেমন মিইয়ে গিয়েছে। পটল, ঝিঙে, উচ্ছে, মুলো ফলনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সব্জির চেহারাও আর তেমন তাজা নয়।” আর, হাওড়ার চেঙ্গাইলের মাঠে বসে তপন দাসের আক্ষেপ, “এত দিন অনাদরে হত যে আদা কিংবা টমেটো, গত কয়েক বছর ধরে মাটি কাটার ফলে সে সবের ফলনও মার খাচ্ছে।” তাহলে মাটি কাটতে দিচ্ছেন কেন?
এ বছর হুগলির বিভিন্ন জায়গায় মাটির মূল্য, ট্রাক প্রতি আড়াইশো থেকে তিনশো টাকা। ট্র্যাক্টর প্রতি সামান্য কম, ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। নদিয়ায় ট্রাক ও ট্র্যাক্টর পিছু মাটির দর যথাক্রমে ২৫০ টাকা এবং ১৩০ টাকা। দক্ষিণ ২৪ পরগনায়, ২০০ এবং ১২০ টাকা। হরিপালের অশোক দাস বলেন, “ভেবেছিলাম, জমির উপরি ভাগের সামান্য মাটিই তো নেবে তাতে টাকাও আসবে জমির কর্ষণও হবে। তাই প্রথম দিকে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম দেড় ফুট বলেও ইটভাটার লোকজন প্রায় তিন-চার ফুট গভীর করে মাটি কাটছে। বাধা দিলে পাল্টা হুমকি দিচ্ছে।” নদিয়ার চাপড়ার ইস্রাইল আলির কথায়, “ফলন কমে যাওয়ায় এ বার জমিটা নিজেই নিড়ান দিয়ে চেহারা ফেরাবো ভেবেছিলাম। ইটভাটার মালিক লোক পাঠালে মাটি দেব না বলে দিয়েছিলাম। রাতে গুন্ডা পাঠিয়ে আমাকে হুমকি দিল, মাটি না দিলে লাশ পড়ে যাবে।” উপরি আয়ের স্বাদ নিতে গিয়ে দক্ষিণবঙ্গের কয়েক হাজার চাষি এখন এ ভাবেই ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছেন।
কল্যাণীর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “লোভে পাপ, আর পাপে মৃত্যু। দক্ষিণবঙ্গের ওই জেলাগুলিতে আবাদি জমি থেকে ইটভাটার মালিকেরা ক্রমান্বয়ে মাটি তোলায় জমি তার উর্বরতা খুইয়েছে। উৎকর্ষতা হারানো ওই জমিতে আর ভাল ফলন হবে কী করে। চাষিরা কাঁচা টাকার লোভে এত দিন জমির মাটি বিক্রি করেছেন। এখন হাত কামড়াচ্ছেন।”
চাষিদের এই ‘লোভ’ আবাদি জমির চেহারা-চরিত্র ঠিক কতটা বদলে দিয়েছে তার খোঁজ দিচ্ছেন সদ্য অবসর নেওয়া রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের মুখ্য আইন অফিসার বিশ্বজিত মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট ২০০৯ সালে নির্দেশ দিয়েছে, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একশো কিলোটিমারের মধ্যে ইটভাটা করা যাবে না। অথচ, দক্ষিণবঙ্গের ব্যান্ডেল, বজবজ, টিটাগড় অধিকাংশ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরেই ইটভাটার রমরমা।” কিছু দিন আগে পরিবেশ মন্ত্রী সুদর্ষন ঘোষ দস্তিদার বিধানসভার বিদ্যুৎ বিষয়ক স্টান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান কেপি সিংহদেওকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছেন। বিষয়টি জানানো হয়েছে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্ট্যোপাধ্যায়কেও।
কিন্তু সেই সতর্ক বার্তা কি ইটভাটা মালিকদের কাছে পৌঁছিয়েছে? রাজ্যর ব্রিকফিল্ড অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জোর করে মাটি কাটার প্রশ্ন নেই। চাষিরা তাঁদের মাটি কাটার অনুমতি দিলে তবেই তাঁরা কৃষি জমি থেকে মাটি কাটেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসারে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একশো কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা তৈরি করা হল কেন? ইটভাটার কারবারিদের মতো এ প্রশ্নের উত্তর হাতড়াচ্ছে রাজ্য সরকারও। |