সরকারের বেঁধে দেওয়া ১১ টাকা দামে পাইকারি বাজারে আলু মিলছে না। সে জন্যই খুচরো বাজারে তা ১৩ টাকা দামে বিক্রি করা যাচ্ছে না বলে দাবি করেছিলেন আলুবিক্রেতারা। এই পরিস্থিতিতে আজ, মঙ্গলবার থেকে শহরের সব ক’টি বাজারের খুচরো বিক্রেতাদের কাছে ১১ টাকা কেজি দরে জ্যোতি আলু পৌঁছে দেবে সরকারি গাড়ি। কেজি প্রতি ২ টাকা লাভ রেখে ওই আলু তাঁরা ১৩ টাকা দামে বিক্রি করবেন। কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশেই এই ব্যবস্থা কার্যকর করা হচ্ছে। রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় জানান, কলকাতায় সমস্যা বেশি। তাই এই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কলকাতার জন্যই।
কিন্তু সরকারের এই নয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সরকারি কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, পাইকারি বাজার থেকে কিনে পরিবহণ খরচ মেটানোর পরে সরকারের বেঁধে দেওয়া দরে আলু বিক্রি করা যে সম্ভব নয়, তা ঘুরপথে ভর্তুকি দিয়ে মেনে নিল রাজ্য। সরকার কেন এই প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রাজ্যের বক্তব্য, আলু সাধারণের নাগালে রাখতেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত শুক্রবার জ্যোতি আলুর পাইকারি ও খুচরো দর যথাক্রমে কেজি প্রতি ১১ ও ১৩ টাকায় বেঁধে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এর থেকে বেশি দাম নেওয়া হলে বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছিলেন তিনি। ওই ঘোষণার পরেই এনফোর্সমেন্ট শাখা ও পুরসভার কর্মীরা দফায় দফায় বাজার অভিযানে নামেন। কয়েকটি জেলায় গ্রেফতারও করা হয় খুচরো আলুবিক্রেতাদের।
এই ব্যবস্থা কিন্তু আলুর দাম কমাতে পারেনি। উল্টে ব্যবসায়ীরা হিমঘর থেকে আলু না তোলায় জোগানে টান পড়ে। অনেক বাজার থেকে কার্যত উধাও হয়ে যায় আলু।
কেন এই অবস্থা তৈরি হল?
কলকাতার এক আলু ব্যবসায়ীর কথায়, “কী হিসেবে আলুর খুচরো দর ১৩ টাকায় বাঁধা হল, বুঝলাম না। পাইকারি বাজারে আলুর দাম ঠিক হয়েছে কেজি প্রতি ১১ টাকা। ওই দামে মাল কিনে তা বয়ে আনার খরচ আছে। তার পর বস্তার ভেতরে কিছু নষ্ট আলুও থাকে। খুচরো বাজারের ক্রেতাকে তা বিক্রি করা যায় না। তাই ১১ টাকায় কিনে সব খরচ মিটিয়ে ১৩ টাকায় আলু বিক্রি করে সামান্য লাভ করাও সম্ভব নয়। তাই বাজারে অনেকেই আলু বেচা বন্ধ করে দিয়েছেন।” অনেক আলুবিক্রেতার অভিযোগ, ১১ টাকা দরে পাইকারি বাজারে আলু মিলছে না। মানিকতলার আলুবিক্রেতা বাপি সাউ বলেন, “পঞ্চাশ কেজির আলুর বস্তা কিনছি ৬৪০ টাকায়। অর্থাৎ, প্রতি কেজিতে দাম পড়ছে ১২ টাকা ৮০ পয়সা। এই দামে কিনে নিজেদের খরচে বাজারে এনে, পচা-ধসা আলু বাদ দিয়ে কী করে তা ১৩ টাকা দামে বিক্রি করা যায়, মাথায় ঢুকছে না।” প্রতিটি বাজারের আলু ব্যবসায়ীরাই কার্যত একই কথা বলেছেন।
ব্যবসার এই সরল সূত্র মেনেই বাজার থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে আলু। ফলে ভাইফোঁটার আগে বিপাকে সরকার। পরিস্থিতি সামলাতে সোমবার বিকেলে কলকাতা পুরসভায় এক জরুরি বৈঠক হয়। বৈঠকে হাজির ছিলেন পুরসভার মেয়র পারিষদ (বাজার) তারক সিংহ, পুর কমিশনার খলিল আহমেদ, টাস্ক ফোর্সের সদস্যরা, বিভিন্ন বাজার সমিতির প্রতিনিধি এবং পুরসভার বাজার দফতরের অফিসারেরা। ওই বৈঠকেই ঠিক হয়, কৃষি বিপণন দফতর আলু তুলবে। তা পুরসভা নিজের খরচে ট্রাকে করে কলকাতার বিভিন্ন বাজারে পৌঁছে দেবে। অর্থাৎ, আলুর দাম ও জোগান স্বাভাবিক রাখতে ঘুরিয়ে সরকারি ভর্তুকিই চালু করল রাজ্য।
কলকাতার খুচরো বাজারে নিজেদের খরচে আলু পৌঁছে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত সরকার এ দিন নিয়েছে, তাতে অবশ্য আলুর দাম ঠিক করার পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন উঠল বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীদের একাংশ। কৃষি বিপণন দফতরের কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, সরকার খুচরো ও পাইকারি বাজারে আলুর দাম নির্ধারণ করতেই পারে। কিন্তু তা বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত। যাঁরা দাম ঠিক করছেন, তাঁদের উচিত ছিল, কী দামে চাষিদের কাছ থেকে আলু কেনা হয়েছে, তা হিমঘরে রাখতে কী খরচ হয়েছে, এর উপরে ব্যবসায়ীদের কতটা মুনাফা থাকছে তা হিসেব করে পাইকারি বাজারের দাম নির্ধারণ করা। একই ভাবে পাইকারি বাজার থেকে খুচরো বাজারে আনার খরচ, নষ্ট হওয়া আলুর দাম এবং বিক্রেতার লাভ যোগ করে ঠিক করতে হবে খুচরো বাজারের দর। এই পদ্ধতি ঠিক মতো মানা না হলে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রেও বাস্তবে সেটাই হয়েছে বলে মনে করছেন ওই অফিসারেরা।
এখন সরকার যে ভাবে নিজের খরচে বাজারে আলু পৌঁছে দিতে চাইছে, তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই মনে করেন, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সরকারের ঢোকাই উচিত নয়। তাঁদের বক্তব্য, আলুর দাম নির্ধারণের পদ্ধতি যে ঠিক হয়নি, তা ট্রাকে করে বাজারে আলু পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে উচিত ছিল, ফের সব মহলের সঙ্গে আলোচনায় বসে আলুর দামের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা। আলুর জোগান স্বাভাবিক থাকলে দামের সামান্য হেরফের হলেও সাধারণ মানুষ আপত্তি করতেন না বলে ওই কর্তাদের দাবি। তা না করে সরকার আলু পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে ঠিক করেনি বলেই মনে করছেন সরকারের ওই কর্তারা।
বাজারে বাজারে কী ভাবে আলু পৌঁছে দেবে সরকার?
পুরসভার মেয়র পারিষদ তারক সিংহ জানান, কলকাতার ৩৫৮টি বাজারকে ৬টি অঞ্চলে ভাগ করা হচ্ছে। সেগুলি হল গার্ডেনরিচ, বেহালা, যাদবপুর, দক্ষিণ কলকাতা, মধ্য কলকাতা ও উত্তর কলকাতা। প্রতিটি অঞ্চলের বাজারে আলু বোঝাই লরি যাবে। লরির ভাড়া মেটাবে সরকার। যে বিক্রেতা যত পরিমাণ আলু নেবেন, তাঁকে কেবল ১১ টাকা কিলো দরে দাম মেটাতে হবে। অর্থাৎ, খুচরো বিক্রেতার ঘাড়ে আর পরিবহণ খরচ চাপছে না।
কিন্তু পুরসভা ওই আলু কোথা থেকে পাবে?
মহাকরণ সূত্রের খবর, রাজ্যের কৃষি বিপণন দফতর আলু জোগানের ভার নিচ্ছে। তাদের সহায়তা করবে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলি। কৃষি বিপণনমন্ত্রী বলেন, “আমরা সব জায়গায় আলু পাঠাব। সখের বাজার গুদাম থেকে আলু দেওয়া হচ্ছে। তা পাঠানো হবে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে।”
কৃষি বিপণন দফতরের কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, বাম আমলেও সরকার আলু বিক্রি করতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছিল। আলুর দাম কমাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আমজনতার করের টাকাই খরচ করেছিল তারা। তৃণমূল সরকার আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কার্যত একই পথে চলেছে। সরকারি কর্তাদের মতে, রাজ্যের হিমঘরে এখন যে পরিমাণ আলু মজুত আছে, তাতে এ রাজ্যের চাহিদা মিটিয়েও ভিন্ রাজ্যে রফতানি করা সম্ভব। ভিন্ রাজ্যে আলুর দাম বেশি বলে বিক্রেতাদের লাভের পরিমাণও বাড়বে। সরকারের উচিত ভিন্ রাজ্যে আলু সরবরাহ করে ব্যবসায়ীদের লাভের সুযোগ করে দেওয়া। অন্য রাজ্যে আলু বিক্রি করে বেশি লাভ হলে, এ রাজ্যে কম লাভে আলু বিক্রি করলে তাঁদের লোকসান হবে না। সরকারের উচিত এই বিষয়ে নজর রাখা। তা না করে ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানো বন্ধ করলে ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়বেন এবং আখেরে ক্ষতি হবে আলু চাষিদেরই।
|