প্রশাসনের কড়া দাওয়াইয়ে ফল হল দু’রকম। কলকাতা-সহ অধিকাংশ জেলায় অনেক বাজারে কমে গেল আলুর দাম। কোথাও কোথাও আবার বাজার থেকে আলুই উধাও। রবিবার সকালে অনেক এলাকায় গৃহকর্তারা বাজারের থলি হাতে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। কিন্তু আলুর দেখা মেলেনি।
এই অবস্থা চলতে থাকলে ভাইফোঁটায় আলুর দাম ফের বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। রাজ্য সরকারকে বিঁধে আলু-রাজনীতিতে নেমে পড়েছে বিরোধী শিবিরও। প্রশ্ন উঠছে, খোদ মুখ্যমন্ত্রী কড়া হাতে রাশ ধরেছেন বলেই প্রশাসন ধরপাকড়ে নেমেছে। তা সত্ত্বেও আলু অমিল কেন?
খুচরো ব্যবসায়ীদের জবাব, সরকার আলুর দর বেঁধে দিয়েছে ১৩ টাকা কিলোগ্রাম। কিন্তু পাইকারি বাজারেই তো এই দামে আলু কিনতে হচ্ছে। ১৩ টাকায় আলু কিনে একই দামে তা বিক্রি করা সম্ভব নয়। তাই আলু বিক্রিই বন্ধ রাখছেন তাঁদের অনেকে। আবার অনেক খুচরো ব্যবসায়ীর দাবি, বিক্রির জন্য এখন তাঁদের হাতে যে-আলু আছে, তা বেশি দামে কেনা। ১৩ টাকা দরে বেচলে লোকসান তাঁদেরই। নতুন করে যে-সব আলু আসছে, সেগুলির দাম কম হবে বলেই আশা করছেন তাঁরা। কিন্তু তা যদি না-হয়, তাঁরা কিছু দিন আলু বিক্রি বন্ধই রাখবেন।
আলু নিয়ে এই আতান্তরের মধ্যেই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা শানিয়েছেন বিরোধী দলের নেতারা। রবিবার হাসনাবাদের জনসভায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “আলুচাষিরা দাম পাচ্ছেন না। এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ নিজের ইচ্ছেমতো আলুর দাম ১৩ টাকায় বেঁধে দিলেন। এ ভাবে গরিব কৃষকদের জীবন-জীবিকার উপরে আক্রমণ নেমে আসছে।” এর মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কিছু পরামর্শও দিয়েছেন সূর্যবাবু। তিনি বলেছেন, “যাঁরা এ-সবের প্রতিবাদ করছেন, তাঁরা আপনার (মমতার) সঙ্গে কথা বলতে যাবেন। তাঁদের কথা শুনুন।” |
অনেক ক্ষেত্রেই যে আলু পাওয়া যাচ্ছে না, প্রশাসনের কর্তারাও তা মেনে নিয়েছেন। তবে তাঁরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার ১৩ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার বলেন, “কোনও কোনও মহল থেকে জোগানে ব্যাঘাত ঘটানোয় অনেক জায়গায় আলু পাওয়া যাচ্ছে না। সে-ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আমরা আলুর জোগান বাড়িয়ে দেব। বেঁধে দেওয়া দামে যাতে রাজ্যের সব মানুষ আলু কিনতে পারেন, যে-কোনও মূল্যে তার ব্যবস্থা করা হবে।” প্রদীপবাবুর দাবি, এ দিন শ্যামবাজার, শখের বাজার, হাতিবাগান-সহ কলকাতার বেশির ভাগ বাজারে আলু বিক্রি হয়েছে ১৩ টাকা কেজি দরেই। সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন বাজারের সামনে গাড়ি নিয়ে গিয়ে এই দামে আলু বিক্রি করা হয়েছে।
সরকারি কর্তার এমন দাবি সত্ত্বেও অনেক বাজারে এখনও ১৪ টাকা দরে আলু বিক্রির প্রবণতা দেখা গিয়েছে। মানিকতলা বাজার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক প্রভাত দাস বলেন, “মজুত আলু বেশি দামে কেনা হয়েছিল। তাই তা ১৩ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব নয়। এ বার পাইকারি বাজারে আলুর দাম কমবে বলেই মনে হচ্ছে। নইলে আমরা আলু বিক্রি বন্ধ রাখব।”
এ ভাবে আলু বিক্রি বন্ধের মোকাবিলায় কী করছে সরকার?
মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপবাবু বলছেন, “আমরা খুচরো ব্যবসায়ীদের আবেদন জানিয়েছি, প্রয়োজনে আমাদের কাছ থেকে ১১ টাকায় কিনে আলু বিক্রি করুন।” এই দামে আলু মিলবে কোথায়, তার হদিস দিয়েছেন কৃষি বিপণন উপ-অধিকর্তা গৌতম মুখোপাধ্যায়। তিনি জানান, শখেরবাজারে পুরসভার গুদামে ৩০ লরি আলু রাখার গুদাম মিলেছে। এ ছাড়াও মানিকতলা, গড়িয়াহাট, কালীঘাট, শ্যামবাজার, শ্যামপুকুরে ১১ টাকা কেজি দরে পাইকারদের আলু দেওয়া হচ্ছে। খুচরো আলু মিলছে ১৩ টাকায়। কৃষি বিপণন অধিকর্তা হরেরাম রায়মণ্ডলের দাবি, সরকার সাতটি বাজারে ১৩ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করছে। ১ নভেম্বর থেকে রবিবার পর্যন্ত এই দামে ২০ টন আলু বিক্রি হয়েছে।
কলকাতায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও জেলার অনেক জায়গাতেই বাজারে আলু মিলছে না। মিললেও তা বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, দক্ষিণবঙ্গে দর কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও উত্তরবঙ্গের বেশির ভাগ বাজারেই আলু বিকোচ্ছে বেশি দামে। লাভ হচ্ছে না দেখে এবং প্রশাসনের হ্যাপা পোহাতে হবে ভেবে শিলিগুড়ির বিভিন্ন বাজারে বর্ধমান থেকে জ্যোতি আলু আনা বন্ধ করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে সেখানকার বিভিন্ন বাজারে ওই আলু মিলছে না। বর্ধমানের আলু উত্তরবঙ্গে আনা বন্ধ রাখা হয়েছে কেন?
শিলিগুড়ির ফ্রুট অ্যান্ড ভেজিটেবল কমিশন এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম কর্মকর্তা তপনকুমার সাহার বক্তব্য, বর্ধমানে হিমঘর বা গুদাম থেকে যে-আলু বেরোচ্ছে, সরকার তার দর বেঁধে দিয়েছে সাড়ে ১০ টাকা কেজি। কিন্তু শিলিগুড়িতে আলু আনতে প্রতি কেজিতে দু’টাকা ৩০ পয়সা খরচ। কৃষি বিপণন দফতরকে এক শতাংশ কর দিতে হচ্ছে। তপনবাবুর প্রশ্ন, “সব মিলিয়ে খরচ ১৩ টাকা হলে খুচরো ব্যবসায়ীদের ১১ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি করা যাবে কী ভাবে? তাই বর্ধমানের আলু আনা হচ্ছে না। রবিবার বাজার বন্ধ ছিল। সোমবার ব্যবসায়ীরা যেমন যেমন কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তার উপরে পরবর্তী পরিস্থিতি নির্ভর করবে।”
উত্তরবঙ্গে শুধু শিলিগুড়ি নয়, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার-সহ সব জেলারই অনেক জায়গায় আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। ধূপগুড়ি ও ফালাকাটা বাজারে এ দিনও ভুটান আলু ২৫ টাকা এবং স্থানীয় আলু ২০ টাকা কেজি দরে বিকিয়েছে। কোচবিহারের ভবানীগঞ্জ, তুফানগঞ্জ, দিনহাটা, মাথাভাঙা, মেখলিগঞ্জের বাজারগুলিতে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে আলু বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ। জলপাইগুড়িতেও আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ এবং ১৮ টাকা দরে। আশার খবর, আজ, সোমবার থেকে পাইকারি বিক্রেতাদের জন্য ফের হিমঘরের আলু তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্যের প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি। খোলা বাজারে আলুর দাম বেড়ে যাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভিন্ রাজ্যমুখী আলুর ট্রাক আটকে দেওয়া হয় বিভিন্ন চেকপোস্টে। তার পরেই শনিবার থেকে তিন দিন ব্যবসা বন্ধের ডাক দিয়েছিলেন তাঁরা।
তবে সরকারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সোমবার থেকে ফের আলু তোলা হবে বলে জানান সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের গড়া টাস্ক ফোর্সের সদস্য দিলীপ প্রতীহার।
|