কেনিয়ার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরির পর হেলমেট খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সদ্যপ্রয়াত বাবাকে স্মরণ করছেন সচিন তেন্ডুলকর ক্রিকেট রূপকথার জন্ম হয় যা থেকে, সেই অবিনশ্বর মুহূর্তেগুলোর অন্যতম ছবিটা। অথচ যে পরিবার তার প্রধানকে হারিয়েছিল, সেই তেন্ডুলকরদের জন্য বাবার শ্রাদ্ধবাসর ভুলে সচিনের ক্রিকেট মাঠে ফিরে যাওয়াটাই ছিল সবচেয়ে স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত! “বাবা যদি এক মুর্হূতের জন্যও পরলোক থেকে ফিরে আসতে পারতেন, তা হলে উনিও সচিনকে বলতেন, ফিরে গিয়ে মাঠে লড়াই করো। পরিবারের প্রত্যেকেই তখন মনে করেছিল যে, বাবার পারলৌকিক অনুষ্ঠানে থাকার বদলে বিশ্বকাপে সচিনের ফিরে গিয়ে দেশের হয়ে খেলাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
বক্তা অজিত তেন্ডুলকর। আশৈশব ছোট ভাই সচিনের বন্ধু, পরামর্শদাতা, পথপ্রদর্শক। এবং অবশ্যই নিঃশব্দ ছায়াসঙ্গী। এগারো বছরের সচিনের হাত ধরে এক দিন তিনিই নিয়ে গিয়েছিলেন রমাকান্ত আচরেকরের কাছে। পাকিস্তানে জীবনের প্রথম টেস্ট সিরিজে ষোলো বছরের ভাই যখন ওয়াকার ইউনিসের বল নাকে খেয়ে রক্তাক্ত, মাঠে বসে শিউরে উঠেছিলেন। আবার সচিন যে দিন অবসরের সিদ্ধান্ত নিলেন, সে দিন প্রথম পরামর্শের জন্য দাদার কাছেই ছুটে গিয়েছিলেন। সেই দাদা অজিত তেন্ডুলকর এ দিন সর্বভারতীয় এক নিউজ চ্যানেলে জানালেন, তাঁর মতে, একেবারে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সচিন। |
“ওকে একদিন থামতে হতই। ইদানীং প্রতিটা সিরিজের শেষে সচিন নিজের পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন করতে বসত। অবসরের চিন্তাটা নিয়ে নাড়াচাড়া চলছিলই, তাই আমরা কেউ শকড্ হইনি। ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত। মাথা উঁচু করে বিদায় নিচ্ছে।” অজিত জানিয়েছেন, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বন্ধু ও অনুরাগীদের অনেকের আর্জি ছিল যে, সচিন যখনই অবসর নিন না কেন, সিদ্ধান্তটা অন্তত এক মাস আগে ঘোষণা করেন। “যাতে ওরা সচিনের শেষ ম্যাচ দেখতে আসার বন্দোবস্ত করার সময় পায়। সচিন সে জন্যই ঘোষণাটা করে দিয়েছিল,” বলছিলেন অজিত। তবে সচিন সিদ্ধান্তটা নেওয়ার পরে তিনি নিজে এবং পরিবারের বাকিরা প্রচণ্ড আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেও সচিন নাকি একদম স্বাভাবিক ছিলেন। উলটে হেসে বলেছিলেন, “আরে তোমরা তো আমাকে এখনই রিটায়ার করিয়ে দিচ্ছ। আমার সামনে এখনও পুরো দশটা দিন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেট পড়ে রয়েছে। এই দশটা দিন ক্রিকেটটা পুরোপুরি উপভোগ করতে চাই।”
১৯৮৯-র লাহৌর টেস্টে মনোজ প্রভাকরের রান আউটের পর টিভিতে সচিনকে দেখে যখন বুঝতে পারেন, তিনি ঘটনার জন্য নিজেকে দোষী ঠাওরাচ্ছেন, বাবা এবং বড়দা নীতিনের সঙ্গে বসে ঠিক করে ফেলেন, ভাইয়ের পাশে থাকা দরকার। “ওর বডি ল্যাংগুয়েজ বলছিল, পারলে তখনই ড্রেসিংরুমে ছুটে গিয়ে ক্ষমা চায়। বুঝে যাই সচিনের পাশে আমার থাকা দরকার।” এর পর দাদার উপস্থিতিতেই নাকে বল খাওয়ার সেই ঘটনা। যা নিয়ে অজিত বলছেন, “সচিনের বড় গুণ, ঝটিতি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ওই রক্তাক্ত অবস্থাতেও পাকিস্তানের কয়েকজন সিনিয়র ওকে ঘিরে ধরে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টায় ছিল। কিন্তু ও ড্রেসিংরুমে না ফিরে খেলার সিদ্ধান্ত নেয়। আর পরের দু’টো বলে ফ্লিক আর ব্যাকফুট ড্রাইভ মেরে পাকিস্তানিদের বুঝিয়ে দেয়, ইট মারলে পাটকেলে জবাব পাবে।” |
সচিনের সেরা ইনিংস বাছতে গিয়েও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দু’টো ইনিংস বেছে নিচ্ছেন। ওয়ান ডে-তে ২০০৩ বিশ্বকাপের ৯৮ আর ১৯৯৯ চেন্নাই টেস্টের ১৩৬। আর ভাইয়ের রেকর্ডের পাহাড় থেকে বেছে নিচ্ছেন সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি! “ওটা মনে হয় ক্রিকেটের বিরলতম রেকর্ডগুলোর একটা হয়ে থাকবে। আর যখনই লোকে ওটা নিয়ে আলোচনা করবে বলা হবে ভারতের সচিন তেন্ডুলকর করেছিল। এটাই সবচেয়ে বড় কথা।”
প্রথম সিরিজের পর থেকে কিন্তু আর সচিনের খেলা দেখেননি অজিত। সচিনের খেলা দেখে না তেন্ডুলকর পরিবার। শুধু পরে ম্যাচের হাইলাইটস দেখার চল রয়েছে বাড়িতে। অজিত বলছিলেন, “এর দু’টো কারণ রয়েছে। প্রথমত, ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান একটাই ভুল করার সুযোগ পায়। কিন্তু পরিবার হিসাবে নিজের প্রিয়জনকে সেঞ্চুরি করে আউট হতে দেখাও কষ্টের। আর দ্বিতীয় কারণটা একেবারেই নিখাদ ভারতীয় কুসংস্কার বলতে পারেন। আসলে একটা সময় সচিন খুব ধারাবাহিক ভাল খেলতে শুরু করল। ধারাবাহিক ভাবে সেঞ্চুরি করছিল। সেই সময় আরও বেশি করে ওর খেলা দেখতে চাইনি। বলে না, প্রিয়জনদের নজর আগে লাগে! খালি সেটাই ভাবতামকঁহি নজর না লগ যায়!”
তবে দু’শোতম টেস্টে ভাঙতে চলেছে এই নিয়ম। মায়ের সঙ্গে গোটা পরিবার হাজির থাকবে ওয়াংখেড়েতে। পরিবারের নয়নের মণিকে শেষ বারের মতো ক্রিকেট মাঠে নজর ভরে দেখতে। |