কানের কাছে সশব্দে ফেটে চলেছে একের পর এক কনফেটি, সেকেন্ড পিছু অন্তত দু’টো। রাশি রাশি গোলাপ-পাপড়ি, রঙিন কাগজের টুকরো ঢেকে ফেলছে তাঁর নাক-চোখ-গাল। মুখ তবু ভাবলেশহীন। নির্লিপ্ত।
সকাল সাড়ে দশটা। ক্লাবহাউস গেট দিয়ে সচিন রমেশ তেন্ডুলকর ঢুকছেন। ঢুকছেন, ইডেনে তাঁর ক্রিকেটজীবনের শেষ টেস্ট যুদ্ধের প্রস্তুতিতে। তবু মুখে অভিব্যক্তির খোঁজ নেই কেন?
মিডিয়ার বুম, ফটোগ্রাফারদের প্রাণান্তকর ‘সচিন..সচিন’ চিৎকারে ন্যূনতম ভ্রূক্ষেপ নেই। মোমের যে প্রতিমূর্তিটা বসেছে ড্রেসিংরুম দরজার ঠিক মুখে, সেটা দেখে বিরাট কোহলির সানগ্লাস নাকের ডগায় নেমে গেল। কিন্তু কোথায়, মরাঠি তো দেখেও দেখলেন না! ফটোগ্রাফারদের অজস্র কাকুতি-মিনতির উত্তরে এক বার হাতটা সামান্য উঠল, সেটাও যেন গভীর অনিচ্ছেয় এবং চোখের পলকে ড্রেসিংরুম দরজার ও-পারে পাঁচ ফুট চারের শরীর অদৃশ্য।
সচিন রমেশ তেন্ডুলকর কি বিরক্ত? |
মুখচোখ লাল করে বেরিয়ে আসছেন সিএবি নিযুক্ত ভারতীয় দলের স্থানীয় ম্যানেজার। এবং সাংবাদিকদের দেখেই তীব্র উষ্মাবর্ষণ, “দেখলেন তো, আপনাদের জন্য ফালতু ঝাড় খেয়ে গেলাম।” কী কুক্ষণে যে ফটোগ্রাফারদের চাপে মোম-মূর্তির পাশে সচিনের একটা ছবির কথা তাঁকে বলতে গিয়েছিলেন বাঙালি ভদ্রলোক! প্রত্যুত্তরে কালক্ষেপও করেননি সচিন, উল্টে যা শুনিয়েছেন, মোক্ষম। স্থানীয় ম্যানেজার কেন, শুনলে যে কারও স্নায়ুর চাপ বেড়ে যাবে!
‘শোনো, এ সব ঝামেলা এখন হঠাও। আমি ছবি তুলতে নয়, এখানে এসেছি ক্রিকেটটা খেলতে। ছবি হবে, কিন্তু পরে। আগে ক্রিকেট।’
অর্থাৎ, অবসরের পৃথিবীতে পা দেওয়ার সন্ধিক্ষণেও সাধনা আগে। উৎসব পরে। কলকাতা কেন, গোটা ভারতবর্ষের সশ্রদ্ধ সম্মান নিশ্চয়ই তাঁর হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কিন্তু আজও ক্রিকেটের চেয়ে মহান কিছুর আগমন ঘটেনি সচিন তেন্ডুলকরের জীবনে। তাই সিএবি-র রাজসূয় যজ্ঞে যেন তিনি থেকেও নেই। শুধু সশরীর উপস্থিতিই থাকে, উৎসবের আবহ থেকে বাদ চলে যায় তাঁর মননটা।
যে ইঙ্গিত ইডেনে তাঁর বিদায়ী টেস্টের প্রথম প্র্যাকটিসে। যে ইঙ্গিত ড্রেসিংরুমে টিমমেটদের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তায়।
শোনা গেল, অন্তিম টেস্ট সিরিজের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হওয়ার আগে নাকি এ দিন বিরাট কোহলির মতো কাউকে কাউকে সচিন বলে দেন, চতুর্দিকে মিডিয়ার এই নিরন্তর হই-হট্টগোলে তাঁকে বেশ মুশকিলেই পড়তে হচ্ছে। কারণ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের পর ক্রিকেটটা তিনি আর খেলবেন না। ইডেনেও আর নামবেন না। তাই চান, সম্মানের ইনিংস খেলে বিদায় নিতে। |
যেটা শেষ পর্যন্ত সত্যি হলে বোধহয় আশ্চর্য হওয়ার থাকবে না। সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের তো আজ দরকার ছিল না শিখর ধবনকে নিয়ে পড়ে থাকার। কী দরকার ছিল, দিল্লি যুবকের সুইপ শটের সময় তাঁর পায়ের মুভমেন্ট দেখিয়ে দেওয়ার? যেটা কোচ ফ্লেচারের কাজ, সেটা শেষ পর্যন্ত করলেন তিনি সচিন। পূর্ণাঙ্গ নেট সেশনে প্রয়োজনও ছিল না উমেশ যাদবের আউটসুইঙ্গারগুলো একের পর এক নির্ভুল মনোযোগে ছেড়ে দেওয়ার। বাকি তো আর দু’টো টেস্ট।
সোজা বাংলায়, সোমবারের সচিন বুঝিয়ে দিলেন লাহলির দ্বিতীয় ইনিংস মোটেও অতীত নয়। বরং ইডেনে প্রবল বর্তমান হিসেবেই ওই ফর্মের আবির্ভাব ঘটবে।
কিন্তু সেটা তাঁর ক্রিকেটীয় দিক। শহরের দিকটা আবার নিখাদ অক্রিকেটীয়। সেখানে না আছে এত কিছু বোঝার দায়, না আছে হুল্লোড়ের উড়ন-তুবড়ি ওড়ানো থেকে সরে আসার কোনও ইচ্ছে। যার মধ্যে ঢুকে পড়েছে সিএবি, ঢুকে পড়েছে পুলিশের ব্যারিকেড উড়িয়ে টিম বাসের পাশ দিয়ে দৌড়নো লোকগুলো। সচিনকে হাজির করানো যায়নি, তাতে কী? রীতিমতো ধুমধাম সমেত বাজি ফাটিয়ে এ দিন থেকে শুরু হয়ে গেল তাঁকে নিয়ে চিত্রপ্রদর্শনী। সিএবি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়ার নিত্যনতুন ‘সারপ্রাইজ’-এর ফর্মুলা মেনে অর্ডার চলে গেল কলকাতার প্রখ্যাত মিষ্টির দোকানে। মোম-মূর্তির উদ্বোধনের পর আজ, মঙ্গলবার সচিনের জন্য সিএবি-র নতুন উপহার মিষ্টি দিয়ে তৈরি তাঁর মূর্তি! সঙ্গে চল্লিশ কেজির কেক, টসের স্বর্ণমুদ্রার উদ্বোধন, স্যুভেনির বের করা বাকি আছে কিছু? |
ইডেনে সপ্তাহব্যাপী ক্রিকেট-যজ্ঞে ঢুকে পড়ছে শহরের ফুটবল-সমাজও। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমেডান কলকাতার তিন প্রধানের কাছে ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র বার্তা পাঠিয়েছেন টেস্টের শেষ দিন পর্যন্ত ক্লাব তাঁবু আলো ঝলমলে করে রাখতে। পারলে, জায়ান্ট স্ক্রিন বসাতে। ফুটবলের মহল্লায় যেখানে সচিনের অন্তিম ইডেন টেস্ট চলবে!
যাঁর নির্বাচক জমানায় ক্যাপ্টেন সচিনের অভ্যূদয়, সেই সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ক্লাবহাউসের দোতলায় দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করে চলেছেন, “ইডেনে দু’রান করলেও ওকে নিয়ে আবেগে এতটুকু টান পড়বে না। তবু সেঞ্চুরি না হলেও অন্তত মনে রাখার মতো যেন একটা ইনিংস...।”
ক্রিকেট-ঈশ্বরের মোম-মূর্তির গায়ে সস্নেহে হাত বুলিয়ে চলেছেন তার স্রষ্টা। অস্ফুটে কিছু সংলাপ ভেসে আসছে, “আমার দেড় মাসের কাজ আজ সার্থক। সচিন আমাকে তিন বার ধন্যবাদ দিয়েছে। হাত মিলিয়েছে...!”
কী বলবেন একে? মোহ? ম্যানিয়া? মায়াবী ঘোরে আচ্ছন্ন এক শহর?
থাক। চলুক। আর তো মোটে ছ’টা দিন!
|