রবিবার রাত সাড়ে আটটায় ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন সচিন রমেশ তেন্ডুলকর? এয়ারপোর্ট? নাকি ইডেন?
বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের মতো এয়ারপোর্ট ভিভিআইপি লাউঞ্জে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছে শ’য়ে-শ’য়ে কালো মাথা, পাগলের মতো তারা মোবাইল ক্যামেরার সুইচ টিপছে, উর্দিধারীদের চোখ রাঙানিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে অন্তত এক বারের জন্য ছুঁতে চাইছে ওই সাড়ে পাঁচ ফুটের ক্রিকেটদেবতার শরীর...।
ভারতীয় দলের ম্যানেজার সতীশের মুখ প্রায় কাঁদোকাঁদো। পুলিশকে কাতর গলায় বলে চলেছেন, “প্লিজ, আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিন। আপনারা বুঝতে পারছেন না আমি না গেলে সচিন বেরোবে না।”
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কালীপুজোর প্রসাদ, কালী বিগ্রহের পরিধেয় শাড়ি হাতে নিয়ে মহাসমারোহে মহানায়ক-বরণের প্রস্তুতি নিয়েও সিএবি কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে স্তম্ভিত। প্রসাদী ফুল, একশো নিরানব্বই গোলাপ দিয়ে সচিন-অভ্যর্থনা তো ঠিক আছে। কিন্তু সেটা হবে কোথায়? |
বারবার তো গেট পাল্টাতে হচ্ছে। ‘সচিন...সচিন’ শব্দব্রহ্ম সৃষ্টি করে ছুটে আসা তাঁর অর্ধোন্মাদ ভক্তদের চাপ সামলাতে দিশেহারা পুলিশ সিএবি কর্তাদের চাপ দিয়ে চলেছে, “যা করার তাড়াতাড়ি, খুব তাড়াতাড়ি।” হুড়োহুড়ির চোটে অভ্যর্থনা শেষ দু’মিনিটেরও কম সময়ে, ওরই মধ্যে সচিনের গলায় উঠে পড়ল বিগ্রহের পরিধেয়, হাতে চলে গেল প্রসাদী ফুল, লিটল মাস্টারের মুখ ঢাকা পড়ে গেল বিশাল পুষ্পস্তবকে, এবং সচিন রমেশ তেন্ডুলকর কোনও রকমে প্রসাদী ফুল সিএবি কোষাধ্যক্ষের হাতে পাল্টা ধরিয়ে বলে গেলেন, “সমহালকে রখিয়ে। এখন এটা সামলে রাখুন। মা কালীর জিনিস। আমি সব হোটেলে গিয়ে নিচ্ছি!”
রবিবার রাত সাড়ে আটটায় ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন সচিন রমেশ তেন্ডুলকর? এয়ারপোর্টে? নাকি ইডেনে?
এবং মহানায়ককে ঘিরে আবেগ-বিস্ফোরণের প্রথম পর্ব যদি রবিবাসরীয় কলকাতা এয়ারপোর্ট দেখে থাকে, তা হলে তার দ্বিতীয় পর্ব দেখবে ইডেন। আজ থেকে।
সোমবার সকাল দশটায় টিম ইন্ডিয়ার সঙ্গে যখন ইডেনের ক্লাবহাউস গেট দিয়ে ঢুকবেন সচিন, পরপর কয়েকটা আশ্চর্য ব্যাপার প্রত্যক্ষ করবেন তিনি। ক্লাবহাউস গেট থেকে ড্রেসিংরুমের রাস্তায় চব্বিশটা কনফেটির ‘বোমা’ ফাটবে একের পর এক, রঙিন কাগজের টুকরোর বদলে বেরোবে রাশি রাশি গোলাপ পাপড়ি, তাঁর দীর্ঘ চব্বিশ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনের কথা মনে পড়িয়ে দিয়ে। তিনি যে পথ দিয়ে ঢুকবেন, তার দু’দিকে দাঁড়িয়ে থাকবে একশো কচিকাঁচা, পিঠে লেখা ‘১৯৯’, বুকে আঁকা সচিনের মুখ। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য বোধহয় হবেন ড্রেসিংরুমের দরজার সামনে এসে।
আরে, ওখানেও তো একটা আস্ত সচিন রমেশ তেন্ডুলকর! ওই একই তো উচ্চতা, সেই পাঁচ ফুট চার।
রক্তমাংসের নয়। মোমের! |
ইডেনের সামনে ট্যাবলো। রবিবার। |
যা নাকি সোমবারের মধ্যেই ড্রেসিংরুমের সামনে বসে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিচ্ছেন সিএবি কোষাধ্যক্ষ। সিএবি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া সাংবাদিক সম্মেলনে বলে যাচ্ছেন, “এই ম্যাচটা যদি এখানে না হত, তা হলে সচিনের একশো নিরানব্বই টেস্টটা শুধু রেকর্ড বইয়েই থাকত। আর কিছু হত না।” মানে, সিএবি প্রেসিডেন্টের কথা ধরলে ভারতের অন্য কোনও স্টেডিয়ামে মহানায়কের একশো নিরানব্বইতম টেস্ট ম্যাচ ঘটলে, এমন উন্মাদনাটা যোগ হত না। খুব ভুল কিছু বলেননি বোধহয়। এ দিন বিকেল থেকে যা শুরু হল সেটা যদি সচিন-উৎসবের ‘ট্রেলার’ হয়, তা হলে উৎসবের পূর্ণদৈঘ্যের ‘সিনেমা’-টা আন্দাজ করতে হলে বিষম খেতে হবে নির্ঘাৎ! রীতিমতো জগঝম্প বাজিয়ে আগামী দিন পাঁচেকের জন্য শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল সচিনকে নিয়ে সিএবি-র ট্যাবলো। মহাড়ম্বর সহ উদ্বোধন হল লিটল মাস্টারকে নিয়ে গানের সিডির, যার মধ্যে গান আছে এগারোটা, কেনা যাবে বুধবার থেকে। টেস্টের শেষ দিন আবার আকাশ থেকে সচিনের সম্মানে ঝরে পড়বে অংসখ্য গোলাপ-পাপড়ি, পড়বে একশো নিরানব্বই কেজি, পড়বে তিনটে ছোট ছোট প্লেন থেকে। সঙ্গে রাজ্য সরকার-সিএবি-র যৌথ সংবর্ধনা।
রবিবার রাতেই টিম হোটেলে ঢোকার পর যা ধরে ধরে বলে আসা হল সচিনকে। অনুরোধ করা হল, সময় পেলে এক দিন তিনি যেন সিএবি-র চিত্র প্রদর্শনীটাও এক বার ঘুরে আসেন। শোনা গেল, সচিন নাকি কলকাতার রবিবারের আবেগ দেখে যেমন আপ্লুত, তেমনই নাকি অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছেন সব সরিয়ে শুধু বিদায়ী টেস্ট সিরিজে মন দিতে।
স্বাভাবিক। কিন্তু কলকাতার আবেগ-প্রদর্শন বোধহয় ঠিক ততটাই যুক্তিসঙ্গত।
এই তো শেষ। চাইলেও তো আর কোনও দিন ইডেনের লন দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে আসতে দেখা যাবে না ওই সাড়ে পাঁচ ফুটের ক্রিকেট ঈশ্বরকে।
বাঙালির দুর্গাপুজো, কালীপুজো তাই শেষ নয়। আজ থেকে এ বছরের ‘প্রকৃত’ শারদোৎসবের সবে শুরু! |
হাজার মোমবাতির শুভেচ্ছা
মহানায়কের শহরে পা রাখার আগেই গোটা দেশে শুরু যেন হয়ে গেল সচিনপক্ষ। ইলাহাবাদে দিওয়ালির রাতে হাজার মোমবাতি জ্বালিয়ে মাস্টার-ব্লাস্টারকে শ্রদ্ধা জানাল সমর্থকরা। ২৪ বছর সমর্থকদের সঙ্গে প্রত্যেকটা মুহূর্তে সচিন তেন্ডুলকর জড়িয়ে রয়েছেন। প্রিয় তারকাকে এত সহজে কি বিদায় জানানো যায়? মহাতারকার আরও একটা সেঞ্চুরির আশায় দিওয়ালির রাতে এ ভাবেই তাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসায় কোথায় যেন মিশে গেল প্রার্থনার সুরও।
ঊষার দাবি
কেন্দ্রীয় সরকারের একজন নির্বাচিত ক্রীড়ামন্ত্রী থাকলেও দেশের বেসরকারি ক্রীড়ামন্ত্রী সচিনকে করে দেওয়া উচিত। ভারতীয় ক্রিকেটের মহাতারকাকে নিয়ে এমনটাই দাবি কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ পিটি ঊষার। ঊষা বলেন, “সচিন রাজ্য সভার সদস্য। ক্রমশ পিছিয়ে পড়া খেলাগুলোকে কী ভাবে তুলে আনা যায় সেটা দেখা উচিত সচিনের। তাই ওকে দেশের বেসরকারি ক্রীড়ামন্ত্রী করে দেওয়া উচিত। যাতে বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে তৃণমূল স্তর থেকে কাজ করতে পারে।”
‘সেরা’ উইকেট
১৯৯৯ চিপক টেস্টে সচিনের উইকেট নেওয়ার মুহূর্তটাই তার জীবনের সেরা। পাকিস্তানের প্রাক্তন স্পিনার সাকলিন মুস্তাক এমনটাই বলছেন। সেই টেস্টে জেতার জন্য ভারতকে ২৭১ রান তাড়া করতে হত। ৮২ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ক্রিজে শুরু হয় সচিন আর নয়ন মোঙ্গিয়ার লড়াই। ১৯২ মিনিট লড়াই করে এই জুটি। ৪০৫ মিনিট লড়াই করার পর সচিনের মনসংযোগে চিড় ধরে। ২৫৮ রানে শেষ হয়ে যায় ভারতের ইনিংস। সেই টেস্টে দু’ইনিংস মিলিয়ে ১০ উইকেট পাওয়া সাকলিন বলেন, “সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিলাম সচিনের উইকেটটা পেতে। সবার চোখে আমি খলনায়ক হয়ে যাই তখন। স্টেডিয়াম পুরো স্তব্ধ। কিন্তু সেই মুহূর্তটা আমার জীবনের সেরা।” |