সাপের কামড়ে মৃত্যুর জন্য প্রতি বছর ক্ষতিপূরণ গুনতে হচ্ছে রাজ্য সরকারকে। শুধু বর্ধমান জেলাতেই গত আর্থিক বছরে ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে হয়েছিল ২ কোটি টাকার উপর। চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ৫ মাসেই সেই পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ লক্ষ টাকার উপর। ৭৭টি মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ এখনও দেওয়া বাকি। এ ভাবে চললে এবার ক্ষতিপূরণের পরিমাণ আগের বছরকে টেক্কা দেবে বলে মনে করছেন সরকারি আধিকারিকেরা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যান থেকেও তেমনই ইঙ্গিত মিলছে। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডেপুটি সুপার তাপসকুমার ঘোষ জানিয়েছেন, জুন, জুলাই নাগাদ প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ জন রোগী সর্পদষ্ট হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অক্টোবরের মাঝামাঝি সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭-৮ জনে। যা অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। তাঁর আশঙ্কা, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে শীতেও সর্পদষ্ট রোগীর দেখা মিলবে।
বর্ধমান জেলায় বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় প্রতি বছর সাপের কামড়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। জেলার মঙ্গলকোট, কেতুগ্রাম, খন্ডঘোষ, রায়না, কালনা, পূর্বস্থলী এবং কিছুটা কাঁকসা ও আউশগ্রামে সারা বছরই সাপে কাটার ঘটনা ঘটে থাকে। বর্ষাকাল, বিশেষ করে জুলাই-অগস্ট মাসে এই সংখ্যা বাড়ে বলে কলকাতার স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের একটি রিপোর্টে জানা যায়। ১৯৯২ সালে বর্ধমান জেলার ২৬ টি গ্রামের প্রায় ১৯ হাজার বাসিন্দার উপরে সমীক্ষা চালান সেখানকার গবেষকদের একটি দল। তাঁরা রিপোর্টে জানান, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ৩০৭ জনকে সাপে কামড়েছিল। ২০১ জন প্রথমেই ছুটে গিয়েছিলেন ওঝার কাছে। তবে তার মধ্যে ২৬ জন পরে হাসপাতালেও যান। প্রতি বছর মৃত্যু হচ্ছিল গড়ে ৩১ জন করে। ইদানীং এমন কোনও সমীক্ষা হয়নি। তাই কত মৃত্যু হচ্ছে, তার আন্দাজ পেতে তাকাতে হচ্ছে ক্ষতিপূরণের অঙ্কের দিকে।
সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছে পানাগড়ের সেনা হাসপাতাল। বছর তিনেক আগে এক রোগী মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ভাঙচুরের পর থেকে সাধারণের চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছেন সেনা কর্তৃপক্ষ। বর্ধমান জেলা ছাড়াও বীরভূম ও বাঁকুড়ার সাপে কাটা রোগীরা এখানে ছুটে আসতেন। সারা বছর এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টি স্নেক ভেনম (এভিএস) মজুত থাকে। সরকারি হাসপাতাল থেকেও রোগীকে তাই এখানে রেফার করা হতো মাঝে মাঝে। সেনা হাসপাতালের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, নয়ের দশকের শেষদিকে ২৭৩ টি সাপে কাটা রোগীকে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল, ৮৮ জনকে বিষধর সাপ কামড়েছিল। তার মধ্যে ২ বছরের শিশু থেকে ৬৫ বছরের প্রবীণও ছিলেন। হাসপাতাল পৌঁছাতে সেই রোগীদের আধ ঘন্টা থেকে ২৫ ঘন্টা পর্যন্ত দেরি হয়েছিল।
এই বিলম্বের কারণ কী? সেনা হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, গ্রাম এলাকায় ওঝাদের রমরমা কারবার বজায় আছে। তারপর নিকটবর্তী হাসপাতালে গিয়ে হয়তো দেখা গেল সেখানে এভিএস নেই। আবার উপযুক্ত চিকিৎসকও থাকেন না অনেক হাসপাতালে। সব মিলিয়ে রোগীদের উপযুক্ত চিকিৎসা শুরু হতে বেশ দেরি হয়ে যায় অনেক সময়। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় অনেকের মৃত্যুও ঘটে।
স্বাস্থ্য দফতরের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্ধমান জেলায় গড়ে বছরে তিনশো জন মারা যান সাপের কামড়ে। সব মৃত্যু যে সরকারি ভাবে নথিবদ্ধ হয় এমন নয়। প্রতি মৃত্যু পিছু রাজ্য সরকার মৃতের পরিবারকে ১ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে। বর্ধমান জেলার প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সাপের কামড়ে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ বাবদ ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে ২ কোটি ২ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল। চলতি অর্থ বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই অর্থাৎ অগস্ট পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ৩৩ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। আরও ৭৭টি মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ দেওয়া বাকি। দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “বছরের প্রথম পাঁচ মাসের ধারা সারা বছর বজায় থাকলে মোট বার্ষিক ক্ষতিপূরণের পরিমাণ গত বছরের চেয়ে বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।” |