শব্দদৈত্যকে বোতলবন্দি করা গেল না কিছুতেই। আর এই ব্যর্থতার জন্য আঙুল উঠছে পুলিশের দিকেই। গত ১৬ বছরে ছয় শব্দ-শহিদের মামলায় কারও শাস্তি না-হওয়ায় পুলিশের বিরুদ্ধেই উদাসীনতার অভিযোগ উঠছে। চলতি বছরে শব্দবাজির তাণ্ডবের জন্যও অভিযুক্ত আইন-রক্ষকেরাই।
শব্দবাজির প্রতিবাদ করে কালীপুজোর রাতে এক জন প্রাণ দিলেন। গুরুতর আহত হলেন এক প্রতিবন্ধী যুবক। তাতেও শব্দবাজির তাণ্ডব বন্ধ হল না। দেখা গেল, এক শ্রেণির মানুষ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। রবিবার রাতে শহর জুড়ে বিনা বাধায় ফেটেছে নিষিদ্ধ বাজি। শব্দবাজি ফাটানোর অভিযোগ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের মাটিতে ফেলে পেটানো হয়। এতে আরও কুঁকড়ে গিয়েছে পুলিশ। তাতেই যেন দ্বিগুণ তাণ্ডবে মেতে উঠেছে শব্দদানবের শাগরেদরা। সোমবার রাতে কালীপ্রতিমা বিসর্জনে শব্দবাজি ফাটাতে না-দেওয়ায় খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কাছে, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট এবং হাজরা রোডের মোড়ে পুলিশের সামনেই বিক্ষোভ দেখায় এলাকার কিছু লোক। মিনিট দশেক পরে তাদের সরিয়ে দেয় পুলিশ।
রবিবার গভীর রাত পর্যন্ত কলকাতার কিছু অঞ্চল, সল্টলেক-সহ আশপাশের এলাকায় শব্দবাজির দৌরাত্ম্যে অস্থির হয়েছেন বাসিন্দারা। পরিবেশকর্মীদের বক্তব্য, রবিবার রাতে যে-সব বাজি ফেটেছে, সেগুলি চকোলেট বোমা, কালীপটকার মতো সাধারণ শব্দবাজি নয়। সেগুলি অনেক বেশি শব্দ সৃষ্টিকারী আলোর বাজি বা ‘শেল’ জাতীয় বাজি।
শব্দবাজি যে বন্ধ করা যাচ্ছে না, তার জন্য পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠছে। শব্দ-শহিদের ঘটনায় পুলিশ যে-সব মামুলি ধারায় মামলা করছে, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। চারু মার্কেট এলাকায় প্রতিবাদী প্রতিবন্ধী যুবক রতন মুদিকে মারধরের ঘটনায় পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতার করলেও তাদের বিরুদ্ধে শুধু মারধর ও বাধাদানের অভিযোগে মামলা রুজু হয়েছে। এতে ধৃতদের জামিন পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল বলেই মনে করছেন আইনজীবীরা।
পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ অশোকনগরে নিহত যুবক পিন্টু বিশ্বাসের প্রতিবেশীরাও। শব্দবাজি রুখতে নেমে প্রাণ দিয়েছেন পিন্টুবাবু। ওই ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত গৌতম বল্লভের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে এক দল লোক। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ঠিক সময়ে পুলিশ এলে পিন্টুবাবুকে এ ভাবে মরতে হত না। শব্দবাজি রোখার ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা যে যথাযথ নয়, এর আগে ছয় শব্দ-শহিদের মামলায় কারও শাস্তি না-হওয়াটা তারই প্রমাণ।
পিন্টু-হত্যা এবং প্রতিবন্ধী যুবকের উপরে হামলার ঘটনায় উদ্বিগ্ন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনও। ছুটি থাকা সত্ত্বেও ঘটনাগুলির গুরুত্ব বুঝে কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায় সোমবার দফতরে আসেন। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সব ক’টি ঘটনারই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। কমিশনের যুগ্মসচিব সুজয়কুমার হালদার বলেন, উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারকে দিয়ে পিন্টু-হত্যার তদন্ত করানোর জন্য ডিআইজি (প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ)-কে নির্দেশ দিয়েছেন চেয়ারম্যান। চারু মার্কেটের ঘটনা এবং শব্দবাজির প্রতিবাদ করায় রবিবার টালিগঞ্জে এক বাড়ির মহিলা-সহ তিন জনকে মারধরের তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশ কমিশনারকে। দু’টি ক্ষেত্রেই তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে হবে দু’সপ্তাহের মধ্যে।
অশোকনগরে নিহত পিন্টুবাবুর পরিবারের পিছু ছাড়ছে না আতঙ্ক। এলাকার অন্য বাসিন্দারাও আতঙ্কিত। পিন্টুবাবুকে চপার দিয়ে কুপিয়ে, মাথায় শাবলের ঘা মেরে খুন করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে এলাকারই ছ’জনের বিরুদ্ধে। পিন্টুবাবুর স্ত্রী নমিতাদেবী এ দিন বলেন, “বাইরে থেকে দুষ্কৃতীরা এসে হুমকি দিচ্ছে। ভয়ে ভয়ে আছি। মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছি।” বাসিন্দারা জানান, ময়না-তদন্তের পরে রবিবার সন্ধ্যায় পিন্টুবাবুর মৃতদেহ গ্রামে আসার পরে বাইরের দুষ্কৃতীরা এসে হুমকি দেয়। দোকানপাট বন্ধ করতে এবং বাড়ির আলো নেভাতে বাধ্য করে।
পুলিশ জানায়, পিন্টু-হত্যায় দুই অভিযুক্ত ধরা পড়েছে। চার অভিযুক্ত পলাতক। নিহতের পরিবার নিরাপত্তা চাইলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ধৃত গৌতম বল্লভ এবং সুমিত বিশ্বাস জেরায় দাবি করেছে, অভিযুক্তদের মধ্যে দু’জনকে পিন্টুবাবু মারধর করেন। তার জেরেই তাঁকে খুন করা হয়। পিন্টুবাবুর বিরুদ্ধে সাট্টা, জুয়া-সহ অপরাধমূলক কাজকর্মের অভিযোগ রয়েছে। তবে নিহতের স্ত্রীর দাবি, তাঁর স্বামী ইদানীং কোনও দুষ্কর্মে জড়িত ছিলেন না। পরিবেশকর্মী তথা রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এক দল প্রতিনিধি এ দিন নমিতাদেবীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের কাছেও নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়ে নমিতাদেবী বলেন, “শব্দবাজির প্রতিবাদ করায় স্বামীকে যারা খুন করল, তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হোক। দুষ্কৃতীরা সাজা না-পেলে ভবিষ্যতে আর কেউ শব্দবাজির প্রতিবাদ করতে সাহস পাবেন না।”
বিশ্বজিৎবাবু বলেন, “শব্দবাজি তৈরি করতে গিয়ে সম্প্রতি রাজ্যে ২০-২৫ জন মারা গিয়েছেন। কারবারিরা সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে জানাচ্ছে, তারা কত কুইন্টাল শব্দবাজি বিক্রি করেছিল। তা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এটা প্রশাসনের পক্ষেও অমর্যাদার।” চন্দননগরে একটি পরিবেশ মেলা করে সেখানে পিন্টুবাবুর পরিবারকে অর্থসাহায্য করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে ওই প্রতিনিধিদল।
এ দিন সুকান্তপল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, পলাতক চার অভিযুক্তের বাড়ি তালাবন্ধ। ধৃত গৌতমের বাড়ির দরজা খোলা। জিনিসপত্র লন্ডভন্ড। ভিতরে পড়ে চকোলেট বোমার খালি প্যাকেট। অশোকনগর-কল্যাণগড়ের তৃণমূল পুর-প্রধান সমীর দত্ত বলেন, “এলাকায় সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পুলিশকে বলেছি, দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে অভিযুক্তদের।”
কলকাতার চারু মার্কেট এলাকায় প্রতিবন্ধী যুবক রতনবাবুকে মারধরের ঘটনায় দুই অভিযুক্তকে হরিদেবপুরের কবরডাঙা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, ধৃতেরা নাবালক। দু’জনেরই বয়স ১৭। তাদের বিরুদ্ধে নিছক মারধর ও বাধাদানের অভিযোগে মামলা রুজু হওয়ায় পুলিশের একাংশের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। প্রহৃত রতনবাবু বারবার বলেছেন এবং লিখিত অভিযোগও করেছেন, তাঁর ট্রাইসাইকেলের নীচে চকোলেট বোমা ফাটানো হয়েছে। এতে তাঁর জীবনও বিপন্ন হতে পারত। ধৃতদের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফাটানো এবং খুনের চেষ্টার অভিযোগও আনা যেতে পারত বলে পুলিশের একাংশের অভিমত।
তাঁদের প্রশ্ন, দিল্লিতে গণধর্ষণের ঘটনাতেও দুষ্কৃতীদের মধ্যে এক জন কিশোর ছিল। তা বলে কি তার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ধারায় মামলা রুজু করা হয়নি?
এ দিন দুপুরে বাঙুর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, রতনবাবুকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “বাঁ পাঁজরে আর পায়ে এখনও অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি ওদের চকোলেট বোমা ফাটাতে বারণ করছিলাম। শুধু পুলিশের ভয় দেখিয়েছিলাম। পুলিশকে ফোন করিনি। কিন্তু তখনই আমার বৌদির ফোন এসে যায় আমার মোবাইলে। ওরা ভাবে, আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বলছি। তার পরেই শুরু হয় মারধর।” রতনবাবুর দুশ্চিন্তা, সুস্থ হওয়ার পরেও কী ভাবে চলাফেরা করবেন তিনি, কী ভাবেই বা সামান্য রুজিরোজগার করবেন?
পরিত্রাতা হয়ে দেখা দিয়েছেন দু’জন। পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় ও সমাজকর্মী নিতাই মুখোপাধ্যায়। নিজের পেনশনের টাকা থেকে বিশ্বজিৎবাবু পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। সেই টাকায় রতনবাবুর জন্য আপাতত একটি হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করেছেন নিতাইবাবু। আজ, মঙ্গলবারেই হুইলচেয়ার পৌঁছে যাবে। পুরো কাজটাই চলছে চারু মার্কেট থানার ওসি শুভজিৎ সেনের তত্ত্বাবধানে। |