ঝিমোনো দুপুর পেরিয়ে নিঝুম সন্ধে এখন। কুয়াশা নেমে ধীরে ধীরে ধূসর হচ্ছে চার দিক। দূরে সবুজের অসীম নিস্তব্ধতা, ঝিঁঝির ডাক, কোথাও গিয়ে যেন অদ্ভুত সংযোগ তৈরি করছে সামনের ওই বাইশ গজের বিষণ্ণতার সঙ্গে। একটু আগেও মাঠের আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গুটিকয়েক মনুষ্য-অবয়বকেও তো আর দেখা যাচ্ছে না, ‘লাহলি ওয়েলকামস ইউ, গড অব ক্রিকেট’ জাতীয় ব্যানার গুটিয়ে ফেলা হয়েছে সেই কখন। ঘরের দিকে আনমনে ফিরে যাওয়া সকালের অত্যুৎসাহী মুখগুলো এখন বড় ক্লিষ্ট। কেউ অস্ফুটে জাঠ পেসারকে শাপশাপান্ত করে চলেছেন, কেউ প্রবল আশঙ্কিত ‘আবার ব্যাট হাতে দেখা যাবে তো?’
মোহিত শর্মা কেন যে বলটা করতে গেলেন!
লেগস্টাম্পটা নির্মম ভাবে ছিটকে মাটিতে পড়ে আছে। মিডল স্টাম্পটাও প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে ওর উপর। মহানায়কের মাথা নিচু। কনুইটা অনবরত ঝাঁকিয়ে চলেছেন। মোহিতের বলটা লাফিয়ে আগে ওখানে লেগেছে, পরে উইকেটে। বাড়তি বাউন্সটা ধরতে পারলেন না, ভিতরে ঢুকে আসা ডেলিভারিতে আবার পরাভূত ক্রিকেটের চলমান কিংবদন্তি। সেই সকাল থেকে সমুদ্রগর্জনের শব্দব্রহ্ম সৃষ্টি করা সাদাসিধে মানুষগুলোও আচমকা বিহ্বল। এত অপেক্ষা, এত প্রত্যাশার পর সচিন তেন্ডুলকর ‘শো’ কি না চলল সাকুল্যে পনেরো মিনিট!
দুপুর আড়াইটের একটু পর প্রবেশ, তিনটের গায়ে গায়ে প্রস্থান, মাঝে টি ব্রেক, সাতটা বল, পাঁচটা রান, একটা স্ট্রেট ড্রাইভ ব্যস, সব শেষ! এর পর যদি কোনও লাহলি-বাসী উল্টোনো স্টাম্প আবার দাঁড় করিয়ে ডব্লিউ জি গ্রেসের বিখ্যাত মন্তব্যের অনুকরণে মোহিতকে বলে আসতেন যে, ‘ওহে, আমরা তোমার বোলিং নয়, সচিন তেন্ডুলকরের ব্যাটিং দেখতে এসেছি,’ খুব দোষ দেওয়া যেত কি? |
সচিনকে গার্ড অফ অনার। ম্যাচ শুরুর আগে। ছবি টুইটার।
|
সত্যি বলতে, আজ চেন্নাই সুপার কিংস পেসারের সিংহাসনে বসার কথাই নয়। ওখানে থাকার কথা সচিন তেন্ডুলকরের। সকাল সাড়ে আটটা থেকে যা যা চলল একে একে, তাতে লোকে ভুলতে বসেছিল লাহলিতে একটা রঞ্জি ম্যাচও হচ্ছে, যেখানে সচিন তেন্ডুলকর ছাড়াও মুম্বই-হরিয়ানার আরও একুশটা লোক খেলছে। কিন্তু সে সব তত্ত্বে পাত্তা দেওয়ার সময় কোথায়?
প্লেয়ার্স ড্রেসিংরুম থেকে সচিন বেরোচ্ছেন, দু’পাশে দু’টো টিম দাঁড়িয়ে তাঁকে ‘গার্ড অফ অনার’ দিচ্ছে। একটু পর সচিন মাঠে, মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে কপিল দেব! পাঁচ মিনিটও গেল না, কপিলের পাশে এ বার আরও একজন ভিভিএস লক্ষ্মণ! হায়দরাবাদ থেকে উড়ে এসেছেন হরিয়ানা ক্রিকেট সংস্থার কর্তাদের আমন্ত্রণে। লাঞ্চের সময় ভিভিএসের হাত দিয়ে সচিনকে রৌপ্যফলক দেওয়া হল, যেখানে লেখা থাকল ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে লিটল মাস্টারের সব ক’টা সেঞ্চুরির দিনক্ষণ, দুই কিংবদন্তিকে পাশাপাশি রেখে ফোটোগ্রাফারদের ঝাঁক অপ্রত্যাশিত ফ্রেমের সন্ধান পেয়ে গেল, আর সব দেখেশুনে লাহলি মোটামুটি বিকারগ্রস্ত! সচিন যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে চিল-চিৎকার। মিড অনে ফিল্ডিং করছেন, মিড অফ গ্যালারি থেকে আমন্ত্রণ আসছে ‘সচিন, ইহা আও’। হরিয়ানার একটা করে উইকেট পড়ছে আর নিজ-রাজ্যের লোকজন থেকেই হরিয়ানা ক্রিকেটারদের শুনতে হচ্ছে পৈশাচিক উল্লাস। লাঞ্চের পর মুম্বই ওপেনার ওয়াসিম জাফর ঢিকির-ঢিকির করছেন, বিরক্ত লাহলি টিটকিরি দিচ্ছে, ‘আরে জাফর, তু হঠ্। সচিনকো আনে দে।’ সেই উৎসব শেষ পনেরো মিনিটে।
মোহিত শর্মা কেন যে বলটা করতে গেলেন!
বিকেলের দিকে হরিয়ানার ক্রিকেট কর্তাদের কাউকে কাউকে দেখা গেল, দুঃখ করতে। সীমিত সাধ্যের মধ্যেও তাঁরা চেষ্টার সঙ্গে আপস করেননি। লক্ষ্মণকে এনেছেন। গাওস্কর-বেঙ্গসরকর-শাস্ত্রীদেরও নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। তাঁরা ব্যস্ততার জন্য আসতে পারেননি এবং প্ল্যান বি ভেবেছে হরিয়ানা। দেশের সেরা সেচব্যবস্থা নাকি সচিনকে ঘুরিয়ে দেখানোর ইচ্ছে ছিল কর্তাদের। যে ইচ্ছেয় আপাতত সংশয় বেশি। এক কর্তা দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে বলেও ফেললেন, “এর পর কি আর ও যাবে?”
সচিন শেষ পর্যন্ত সেচব্যবস্থা দেখতে যাবেন কি যাবেন না, সময় বলবে। লাহলির গ্রিন টপে তাঁকে দ্বিতীয় বার ব্যাট হাতে নামতে দেখা যাবে কি না, সেটাও পরবর্তী প্রশ্ন। ঘটনা হচ্ছে, রবিবার লাহলির মননের দু’টো দিক পাওয়া গেল। একটা যদি তাঁকে ঘিরে সাময়িক বিষণ্ণতা হয়, তা হলে দ্বিতীয়টা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। অন্ধকারে স্টেডিয়াম গেট ছেড়ে সচিন তেন্ডুলকরের বেরিয়ে যাওয়া বিএমডব্লিউ তাক করে কয়েকটা শরীরের মরণপণ ‘ডাইভ’ যা বলে দিচ্ছিল।
রবিবারের পর ভারতবর্ষের ম্যাপে লাহলি বলে যত দিন একটা গ্রাম বেঁচে থাকবে, তত দিন সচিন তেন্ডুলকর নিয়ে একটা অমর স্মৃতিও বেঁচে থাকবে। আর কিছু না হোক, রবিবার মাঠে উপস্থিত হাজার দশেক ছেলে-বুড়ো নিজের উত্তরসূরিদের বলে যেতে পারবেন, “জানিস, আমি সচিন তেন্ডুলকরকে দেখেছি।”
তাই তিনি পাঁচ করলেন না পাঁচশো, কিছু এসে যায় না!
সংক্ষিপ্ত স্কোর: হরিয়ানা: ১৩৪। মুম্বই ১০০-৪। |