ভাবনাটা দানা বাঁধছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই। কাজ শুরু হচ্ছে এই প্রথম।
চোখধাঁধানো প্রতিমা বা মণ্ডপের সাজ এর আগে পাঁচতারা হোটেলের লবিতে ঠাঁই পেয়েছে। সমঝদার শিল্পপতির বৈঠকখানার শোভাবর্ধনে কাজে এসেছে থিমের উপকরণ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পুজোর শিল্প সংরক্ষণের পক্ষপাতী। লেকের কাছে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গত বছর থেকেই কিছু প্রতিমা রেখে দিচ্ছে রাজ্য সরকার। কিন্তু পুজোর শিল্পচর্চার ইতিহাস রচনা বা তা নিয়ে গবেষণার লক্ষ্যে পদক্ষেপ সে ভাবে দেখা যায়নি। সেই খামতি মেটাতে এগিয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকারের ললিত কলা অ্যাকাডেমি। সদ্য শেষ হওয়া পুজোর শিল্পকর্ম নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে ডিজিটাল নথি তৈরির কাজ। পাশাপাশি, কলকাতার কপালে আরও একটি প্রাপ্তিযোগ হচ্ছে। এ শহরে ললিত কলা অ্যাকাডেমির আঞ্চলিক কেন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট জমিতে বিভিন্ন পুজোমণ্ডপের শৈলী সাজিয়ে স্থাপত্যের এক নতুন রূপরেখা ঠিক হয়ে গিয়েছে। |
বেশ কয়েক বছর ধরে কলকাতার পুজোর সঙ্গে জড়িত থিমস্রষ্টারা অনেকেই রয়েছেন এই উদ্যোগের নেপথ্যে। নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ অথবা চেতলা অগ্রণীর ‘নায়ক’ ভবতোষ সুতার, বা রাজডাঙা নব উদয় সঙ্ঘের পার্থ দাশগুপ্তদের পরামর্শেই পুজো মণ্ডপের কিছু টুকরো-টাকরা ব্যবহার করে সাজানো হচ্ছে মৌলালির কাছে অ্যাকাডেমির আঞ্চলিক কেন্দ্রের চত্বর। পার্থ বলছিলেন, “প্রতি বছরই পুজোয় কিছু ভাল কাজ হয়। তা কোনও এক জায়গায় ডাঁই করলেই সংগ্রহশালা গড়ে ওঠে না। বরং পুজোর শিল্পকর্ম অন্য একটি সুন্দর কাজে ব্যবহার করলে তা অনেক বেশি অর্থবহ হয়।” ভবতোষও মনে করেন, “পুজোর শিল্পের খুঁটিনাটি-সহ নির্দিষ্ট ক্যাটালগ তৈরি করা এবং সৃষ্টির গল্পগুলো নথিবদ্ধ না-করলে তা ভবিষ্যতে গবেষক বা শিল্প-রসিকদের কাজে লাগবে না।”
মৌলালিতে অ্যাকাডেমির ১৬ কাঠা জমি থেকেই এ কাজ শুরু হচ্ছে। একসঙ্গে বহু মণ্ডপের কাজ মিলিয়ে নতুন সৃষ্টি। কোন মণ্ডপের কী কাজ থাকবে, তার তথ্যও থাকবে কৌতূহলীদের জন্য। অ্যাকাডেমির সদস্য অসিত পালের কথায়, “মণ্ডপ এখন আর বাঁশ-কাপড়ের খাঁচা নয়। পাল্টে যাওয়া মণ্ডপের নিদর্শন ধরে রাখতেই এ ভাবে সাজানোর ভাবনা।” গত পুজোর পরে লেকের কাছে রাজ্যের উদ্যোগেও জড়ো করা হয়েছিল বেশ কিছু প্রতিমা। কোনটা কোন পুজোর বা কোন শিল্পীরসেখানে তা বোঝার উপায় নেই। অ্যাকাডেমি কর্তৃপক্ষ অবশ্য বিষয়টি একটু অন্য ভাবে ভাবছেন। তাই ঠাকুরপুকুরের এসবি পার্কের কাঠের প্যানেল, চেতলা অগ্রণীতে বস্তারের লোকশিল্প, সেলিমপুর ক্লাবের কাঁথা স্টিচের কাজ, রাজডাঙা নব উদয়ের সেরামিক্স-ইটের দেওয়াল, নাকতলা উদয়নের গেট বা হাতিবাগান নবীন পল্লির পাকিস্তানি ট্রাক আর্টের নমুনা পাশাপাশি রেখে সাজানো হচ্ছে এক নতুন ‘মণ্ডপ’।
পাশাপাশিই শুরু হয়েছে ডিজিটাল নথি তৈরি। অসিতবাবুর মতে, “বছর-বছর চলতে থাকা পুজোর কাজ এক জায়গায় রাখতেই ডিজিটাল নথি তৈরি হচ্ছে। ২০১৩ এবং ২০১৪-র পুজোর কাজ নিয়ে একটি বইও মলাট-বন্দি হবে।” চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী এই নথি তৈরির কাজটি গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করেন। তাঁর কথায়, “শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে বলতে পারব না, তবে এটা ঠিকই পুজোয় অনেক বিশিষ্ট শিল্পীদের কাজ ধরে রাখার চেষ্টাই হয়নি।” অতীতে চিত্রশিল্পী নীরদ মজুমদার, বিকাশ ভট্টাচার্য, পরিতোষ সেন, ঈশা মহম্মদ, ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই পুজোয় যুক্ত হয়েছেন। সে-সব কাজের স্মারক এখন কার্যত লুপ্ত।
এই নথি শেষমেশ কী কাজে লাগবে? অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান কল্যাণকুমার চক্রবর্তীর কথায়, “পুজোর থিমেই ধরা পড়ছে, এ কালের শিল্পকলায় বিভিন্ন দেশজ লোকায়ত আঙ্গিকের প্রভাব। আজকের শিল্পীদের মননে কী ভাবে দেশের শিকড় মিশে আছে, তা বুঝতেই এই নথি থাকাটা জরুরি।”
|