ঢাকের আওয়াজে নিশ্চয় চাপা পড়ে গিয়েছিল তরুণীর চিৎকার। ঠিক যেমন, দিল্লির রাজপথে নির্ভয়ার আর্তচিৎকার ঢেকে দিয়েছিল চলন্ত বাসের মিউজিক সিস্টেম।
নবমীর সকাল। দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের একটি পুজো মণ্ডপের ভিতরে মেলে বছর ছাব্বিশের মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণীর অর্ধনগ্ন দেহ। তাঁর বাপের বাড়ি কাছেই। বছর চারেক আগে তাঁর স্বামী তাঁকে এখানে ছেড়ে যান। নিহত তরুণীর জেঠু গঙ্গারামপুর থানায় গণধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। তাঁকে যাতে শনাক্ত না করা যায়, তা নিশ্চিত করতে আততায়ীরা ধুনুচি আর সরা দিয়ে তরুণীর মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল। দিল্লি-কামদুনি মনে পড়ে যাচ্ছে না?
তদন্তে নেমে পুলিশ কালদিঘি এলাকার ওই বারোয়ারি পুজো কমিটির ঢাকি অনুকূল নট্ট ও মণ্ডপের নৈশরক্ষী ভবতোষ গায়েনকে গ্রেফতার করে। তাদের জেরা করে বৃহস্পতিবার রাতে ওই পুজো কমিটির দুই সদস্য টিঙ্কু ওরফে দেবাশিস সিংহ এবং পলাশ চক্রবর্তীকে পুলিশ ধরে। এর আগে জেলা পুলিশ কর্তারা অবশ্য ঢাকি এবং নৈশপ্রহরীকে গ্রেফতার করে তদন্ত সম্পূর্ণ বলে দাবি করেছিলেন। শেষে ঘটনার ১৩ দিনের মাথায় টিঙ্কু-পলাশকে গ্রেফতারের পর ঘটনা নতুন মোড় নিল। পুলিশের দাবি, জেরার মুখে তাদের কাছে ভবতোষ ও অনুকূল জানায়, অষ্টমীর গভীর রাতে তারা পুজো মণ্ডপেই ছিল। সেখানে বসেছিলেন ওই তরুণীও। টিঙ্কু আর পলাশ বেসামাল অবস্থায় সেখানে এসে ওই তরুণীকে জোর করে মণ্ডপের এক কোণে নিয়ে যায়। চেয়ার দিয়ে আড়াল করে তারা তরুণীর উপরে যৌন নির্যাতন চালায়। |
পুলিশের দাবি, জেরার মুখে নৈশপ্রহরী জানান, ওই তরুণী নিজেকে পুরোহিতের ভাইঝি বলে পরিচয় দেওয়ায় টিঙ্কু আর পলাশ ভয় পেয়ে যায়। তারা তখন তরুণীকে গলা টিপে মারে। তরুণীর চিৎকার যাতে কেউ শুনতে না পান, সে জন্য তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে জোরে ঢাক বাজাতে বাধ্য করা হয় বলে ঢাকি অনূকুল পুলিশি জেরায় কবুল করেছে। ভোর রাতে দুর্গামণ্ডপে আরতির ঢাক বাজছে ভেবে স্থানীয় বাসিন্দারাও সন্দেহ করেননি। অনেকটা এমনই হয়েছিল নির্ভয়ার ক্ষেত্রে। ভোরের দিল্লিতে চলন্ত বাসের মিউজিক সিস্টেম দোষীরা জোরে বাজিয়ে দেওয়ায় নির্ভয়ার চিৎকার বাসের বাইরে যায়নি। তবে, ভবতোষ আর অনুকূলের বয়ানে কতটা সত্যতা রয়েছে, তা-ও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। দক্ষিণ দিনাজপুরের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ধৃত নৈশপ্রহরীও নির্যাতনের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত। শেষ পর্যন্ত সে এবং ঢাকি জেরায় ভেঙে পড়ে দুই মূল অভিযুক্তের নাম আমাদের জানিয়েছে। কী ভাবে ওই মহিলার উপর অত্যাচার করে তাঁকে খুন করা হয়, ঢাকি ও নৈশরক্ষীর সেই জবানবন্দির ভিডিও রেকর্ডিং করা হয়েছে। সবকিছুই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, ওই তরুণীর দেহের ময়নাতদন্তে ধর্ষণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু, শরীরে কামড়, আঁচড়-সহ শারীরিক নির্যাতনের একাধিক চিহ্ন রয়েছে।
পুজো কমিটির দুই ধৃত সদস্যই তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী বলে এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন। টিঙ্কু থাকে কালদিঘি হাসপাতাল পাড়ায়। পলাশের বাড়ি পানসমিতি পাড়ায়। দু’জনেই কোনও নির্দিষ্ট কাজ করে না। জেলা তৃণমূল সভাপতি বিপ্লব মিত্র বলেন, “ধৃত দুই যুবকের পরিবার আমাদের দলের সমর্থক। কিন্তু, ওদের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক নেই। এলাকায় সমাজবিরোধী কাজকর্মের সঙ্গে ওই দু’জন জড়িত। পুলিশ ভাল কাজ করেছে।” ওই পুজো কমিটির সম্পাদক তথা তৃণমূলের কালদিঘি অঞ্চল সভাপতি সন্তোষ দাস বলেন, “ধৃতদের পিছনে দাঁড়ানোর প্রশ্ন নেই। প্রথম থেকেই দোষীদের শাস্তি চেয়েছি।”
শুক্রবার দুপুরে ধৃত চার জনকে বুনিয়াদপুরে গঙ্গারামপুর আদালতে পুলিশ হাজির করায়। ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট উমা বন্দ্যোপাধ্যায় সিংহরায়চৌধুরী টিঙ্কু ও পলাশকে ৫ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন। ঢাকি ও নৈশপ্রহরীর ১৪ দিনের জেল হেফাজত হয়। টিঙ্কু-পলাশের আইনজীবী প্রতুল মিত্র বলেন, “প্রহরী ও ঢাকি মূল অভিযুক্ত বলে আদালতে পুলিশ জানিয়েছিল। এ দিন বলেছে, আমার মক্কেলরা মূল অভিযুক্ত। পুলিশের ভূমিকা স্পষ্ট নয়।” |