পুস্তক পরিচয় ১...
গহন বিশ্বাস থেকে উচ্চারিত
স্বামী বিবেকানন্দ/ বাংলা রচনা সংকলন, সম্পা: বিশ্বজিৎ রায়। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২৫০.০০
যে এই রচনাগুলিকে ছোঁয় সে এগুলির স্রষ্টাকেও ছোঁয়, বিবেকানন্দের বাংলা (বা ইংরেজি) রচনা সম্বন্ধে এ কথা স্বচ্ছন্দেই বলা যেতে পারে। ‘রচনা’ কথাটিই আমরা ব্যবহার করছি, তা দিয়ে লিখিত/মুদ্রিত, এবং বক্তৃতা হিসেবে উচ্চারিত দু’ধরনের ভাষাকর্মকেই বোঝানো সম্ভব। বিশ্বজিতের প্রথম আর প্রশংসনীয় উদ্যোগ, তিনি এই প্রশ্নগুলির ধাপ ধরে একে একে এগিয়েছেন—
এক, ঠিক কোনগুলি যথার্থ ভাবে বিবেকানন্দ নিজে রচনা করেছিলেন বাংলায়? কোনগুলি ইংরেজি থেকে অন্য কারও বাংলা করা? এবং
দুই, কোথায় তাদের মধ্যে অন্যদের নানা ধরনের হস্তক্ষেপ ঘটেছেযেমন, দুই ভিন্ন লেখা এক হয়েছে, বা এক লেখা ভেঙে দুই, কিংবা লেখার নাম বদলে গেছে, কিংবা ব্যক্তিকে লেখা চিঠি প্রবন্ধের আকার পেয়েছে?
তিন, লেখাগুলি প্রকাশের ক্রম কী ছিল, যা রামকৃষ্ণ মিশনের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা-র ষষ্ঠ খণ্ডে (শুধু এই খণ্ডেই তার মৌলিক বাংলা রচনাগুলি আছে) রক্ষা করা হয়নি। এই কাজগুলি কোথায় কোথায় ঘটেছে তা বিশ্বজিৎ বিশদ রূপে দেখিয়েছেন। কেন ঘটেছে এ প্রশ্নও তোলা যায়, কিন্তু তাঁর দ্বারা পরীক্ষিত হয়ে যদি আমরা স্বামীজির মূল বাংলা রচনা সেগুলির যথার্থ সত্তা আর ক্রম অনুসারে এ সংকলনে পেয়ে থাকি, তা হলে এখন সে প্রশ্ন এ সমালোচনার পক্ষে জরুরি নয়।
বিশ্বজিতের গবেষণার কাজ ছিল মূল ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার ফাইল মিলিয়ে দেখা। এটা যে কত প্রয়োজন ছিল তা বোঝা যায় হস্তক্ষেপের পরিমাণ ও বৈচিত্র্য দেখে। ‘ভাববার কথা’ নাম দিয়ে ‘উদ্বোধন’-এ যা প্রকাশিত হয়েছিল, গ্রন্থাকারে তার সঙ্গে আরও কিছু সংযোজিত হল। সংযোজিত হল, কিন্তু ভিন্ন নামে। আলাদা এক পুস্তিকা ছিল হিন্দুধর্ম কি, তা হয়ে গেল ওই বইয়ের প্রথম লেখা, নতুন নাম হল হিন্দুধর্ম ও শ্রীরামকৃষ্ণ। ক্যালিফর্নিয়া থেকে ২০.২.১৯০০ সালে লেখা চিঠি হয়ে গেল ‘বাঙ্গালা ভাষা’ নামে প্রবন্ধ, তারও ঠাঁই হল ওই ভাববার কথা-তে, যে বইটি আসলে কয়েকটি লোকগল্পের সমষ্টি। সংযোজনে বইটির বিষয়গত সংহতি রক্ষিত হয়নি। আবার ‘উদ্বোধন’-এ আলাদা আলাদা প্রকাশিত ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’ আর ‘পরিব্রাজক’ রচনাবলির পরিব্রাজক-এ এক করে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বজিৎ তাকে বর্তমান সংকলনে সংগত ভাবেই আলাদা করেছেন। এমনকী তিনি কবিতার মূল মুদ্রিত পাঠে আর রচনাবলিতে যতিচিহ্ন স্থাপনে কী তফাত ঘটেছে তা-ও লক্ষ করেছেন। এই শ্রমনিষ্ঠা ও সতর্কতা সচরাচর দুর্লভ। কিন্তু তিনি তাঁর প্রয়াসের আংশিক অপূর্ণতার কথাও গোপন করেননি। স্বামী বিবেকানন্দের রচনার একেবারে মূল সূত্র, অর্থাৎ পাণ্ডুলিপিগুলি মিলিয়ে দেখার সুযোগ তাঁর হয়নি। বেলুড় মঠে রক্ষিত এই নথিগুলি বাইরের গবেষকদের কাছে উপলভ্য নয়। যদি অচিরে তা না-ও হয়, আমরা আশা করব মঠাশ্রিত কেউ বিশ্বজিতের ওই অনুদ্যোক্ত কাজটি করে আমাদের জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার মহদুপকার সাধন করবেন।
স্বামীজির বাংলা রচনার ঝাড়াই-বাছাই ছাড়াও সম্পাদক যা করেছেন তা হল মূল্যবান টীকা ও পরিশিষ্ট সংযোজন। পরিশিষ্টে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সভাপতির অভিভাষণ’ বাংলা সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিচারের নিদর্শন।
বিবেকানন্দের বাংলা গদ্য সম্বন্ধে বাগ্মিতার যে মূল সূত্রটি বিশ্বজিৎ গ্রহণ করেছেন, তা যথার্থ। তিনি সাধারণ ভাবে বাগ্মিতার ইতিহাস, বিশেষত ঊনবিংশ শতাব্দী-শেষের বাংলায় বাগ্মিতার জনপ্রিয়তার ইতিহাস লক্ষ করেছেন। ব্রহ্মবান্ধবের ত্রিকথা-র ভূমিকাটি পড়লে দেখতেন, ব্রহ্মবান্ধব তাঁর ঠাকুমার একটি উক্তি উদ্ধার করেছেন—‘এই নেকচারেই দেশটাকে খেলে!’ গৃহান্তরীন মহিলাদের এই উক্তি, তখনকার বাগ্মিতার প্রতি বহির্গামী পুরুষের আসক্তির একটি প্রমাণ ও মন্তব্য তো বটেই। বিশ্বজিৎ নানা উদ্ধৃতির সহায়তায় কথা দিয়ে বিবেকানন্দের অন্যের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা, তেজ, সাহস ও মহৎ সংকল্প সঞ্চারের সহজ প্রবণতা দেখিয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের লোক-কথকতাধর্মী গ্রামীণ বাকশিল্পের সঙ্গে তার তুলনা করে দুয়ের প্রভেদ স্পষ্ট করেছেন। একটি জাতি যখন নবজাগ্রত জাতীয়তা আর আত্মচেতনায় উজ্জীবিত হয়ে নিজেকে জাগিয়ে তোলবার চেষ্টা করছে, হোক তা মধ্যবিত্ত ‘ভদ্রলোক’দের বৃহৎ জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন এক অসম্পূর্ণ প্রয়াস, সেখানে বাগ্মিতা এক সমাদরণীয় গুণ হয়ে ওঠে। ১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ বাংলায় বাগ্মিতাশস্যের প্রচুর ফলনের সময়।
কিন্তু অন্য সকলের থেকে বিবেকানন্দের বাগ্মিতা আলাদা হয়ে ওঠে এইখানে যে, আমাদের মনে হয় তাঁর প্রত্যেকটি কথা রক্তমাংসের ওই মানুষটি তাঁর সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে উচ্চারণ করছেন, সামনে দু-একটি মাত্র শ্রোতাকে সম্বোধন করে। এই দু-একজন শ্রোতা তাঁর চেনা। দু-একজন চেনা শ্রোতা আর বহু অচেনা শ্রোতায় বাগ্মিতার তফাত হয়। অনেকে বহু শ্রোতার জন্য বক্তৃতা করেন, তাতে বক্তৃতা কিছুটা নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠে। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতে লন্ডনে বিপিনচন্দ্র পালের একটি বক্তৃতার কথা লিখেছিলেন। একটি ছোট ঘরে তিনি বক্তৃতা করছিলেন, কিন্তু এমন উচ্চকণ্ঠে বলছিলেন যে, মনে হচ্ছিল যেন তিনি পাঁচ হাজার শ্রোতা সামনে পেয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দ অবশ্য তাঁর বৃহৎ শ্রোতৃসমাগমের বক্তৃতাতেও নিজের ভিতরকার তীব্র মানুষটিকে প্রকাশ করতে পারতেন, তার কারণ তাঁর বলার কথাগুলির প্রত্যেকটি তাঁর গহন বিশ্বাস থেকে উচ্চারিত হত। সে বিশ্বাসের যৌক্তিকতা নিয়ে পণ্ডিতেরা তর্ক করতে পারেন, তার স্ববিরোধ দেখাতে পারেন কখনও, কিন্তু তার মধ্যেও ওই মানুষটি তাঁর আমূল ব্যক্তিত্ব সঞ্চারিত করে রাখেন। বাগ্মিতাশাস্ত্রের কায়দাকানুন তিনি যথেষ্টই জানতেন, কিন্তু বাগ্মিতা কখন নিছক কথাকৌশল আর কথাচাতুর্য থেকে বেরিয়ে নিজের কথা হয়ে ওঠে, তা দেখার জন্য বিবেকানন্দের রচনা অবশ্যপাঠ্য। ‘এ যুগের শক্তিকেন্দ্র সামগায়ী, যজুর্যাজী পুরোহিতে নাই, রাজশক্তিও ভারতের বিকীর্ণ ক্ষত্রিয়-বংশ-সম্ভূত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মণ্ডলীপতিতে সমাহিত নহে, এ যুগের দিগ্ দিগন্তব্যাপী, অপ্রতিহতশাসন আসমুদ্র-ক্ষিতীশগণই মানবশক্তিকেন্দ্র’-র (পৃ ৮১) মতো সংস্কৃত শব্দবহুল উচ্চারণ হোক, আর ‘আঁব, কলা, নারিকেল, রাঁধা দধ্যোদন, রাশীকৃত গজা, নিমকি ইত্যাদির বোঝা আসতে লাগলো। ক্রমে ভিড় হতে লাগলো। ছেলে মেয়ে, বুড়ো, নৌকায় নৌকা’ (পৃ ১২৬) ধরনের সহজ বাংলা বাগধ্বনি হোক, তেজে, উদ্দীপনায়, বলিষ্ঠতায়, কৌতুকে, হাস্যে, ব্যঙ্গেসর্বত্রই মনে হয় একটি জলজ্যান্ত স্নায়ুনির্মিত মানুষ উপস্থিত এই কথাগুলির পিছনে। কোনও শব্দ চেষ্টা করে অভিধান থেকে তুলে আনা হয়েছে বা পাণ্ডিত্য দেখানোর জন্য আদিষ্ট হয়েছে মনে হয় না।
বানান সম্বন্ধে এই সমালোচকের নির্দিষ্ট একটি মত আছে, তা সকলের পছন্দ নাও হতে পারে। আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন গ্রন্থাবলি যখন আমরা ছাপি, তাতে কি পুরনো বানান রাখতেই হবে? বানান শব্দের একটা পোশাক মাত্র, কিংবা প্রথাগত অভ্যাস, তাতে লেখকের ব্যক্তিত্ব-প্রকাশের কিছু নেই। স্বামীজি বা বঙ্কিমচন্দ্র বা অন্য কোনও লেখক তাঁদের বানানে বাস করেন না। তবে কেন তাঁদের নতুন সময়ের পাঠকদের জন্য নতুন বানানে পরিবেশন করা হবে না?
দু’একটি ছাপার ভুল চোখে পড়ল। ৯ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় লাইনে ‘প্রশ্নহীভাবে’, ১৬ পৃষ্ঠায় মাঝখানের ইংরেজি উদ্ধৃতিতে ... they learn ‘form’ the school...। কিন্তু প্রকাশনার মান বেশ ভাল, প্রচ্ছদটিও সুন্দর, মূল্য যুক্তিসিদ্ধ। এই অতি প্রয়োজনীয় সংকলনটি প্রকাশের জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিকে ধন্যবাদ জানাই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.