দেড় দশকের আইনি লড়াই অবশেষে মিটিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মার্কিন প্রবাসী চিকিৎসক কুণাল সাহা ছয় কোটি টাকারও বেশি ক্ষতিপূরণ পাইবেন। লড়াইটি তাঁহার ব্যক্তিগত ছিল বটে, কিন্তু তাহার ফল সুদূরপ্রসারী হইবার সম্ভাবনা। প্রথমত, চিকিৎসার দুনিয়ায় তথ্যের অসাম্য প্রবল। চিকিৎসক, অথবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর প্রকৃত অবস্থা, চিকিৎসাপদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে যতখানি জানেন, রোগী বা তাঁহার স্বজনদের পক্ষে তাহা জানা অসম্ভব। ফলে, চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে হাসপাতালের সিদ্ধান্ত, তাহা ঠিক হউক বা মারাত্মক ভুল, মানিয়া লওয়া ভিন্ন রোগীর স্বজনদের উপায় থাকে না। সুপ্রিম কোর্ট এই মামলার রায় ঘোষণার সময় হাসপাতালের উপর নজরদারি বাড়াইবার কথা বলিয়াছে, রোগীর প্রতি তাহাদের দায়বদ্ধতা বাড়াইবার সুপারিশ করিয়াছে। হাসপাতাল যদি চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করিতে বাধ্য হয়, তবে তথ্যের অসাম্য কমিবে। হাসপাতালগুলি যদি জানে, ভুল চিকিৎসা হইলে আজ না হউক কাল তাহা ধরা পড়িবেই, তাহারা অনেক বেশি সচেতন হইবে। ক্ষতিপূরণের অঙ্কটিও এই ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। ছয় কোটি টাকা মুখের কথা নহে। শাস্তি কঠোর হইলে অপরাধপ্রবণতা কমে, তাহা প্রতিষ্ঠিত সত্য। ফলে, বিপুল ক্ষতিপূরণের খাঁড়া ঝুলিলে চিকিৎসক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, উভয়েই অধিকতর দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিবেন বলিয়া আশা করা চলে।
এই রায়ের দ্বিতীয় তাৎপর্য, স্বাস্থ্য যে একটি পরিষেবা, এবং সেই পরিষেবা কিনিয়া কেহ প্রতারিত হইলে যে তাহার প্রতিকার সম্ভব, এই কথাটি প্রতিষ্ঠিত হইল। ভারতে ক্রেতা সুরক্ষার সংস্কৃতি এখনও তেমন ব্যাপক নহে। স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে আরও নহে। বিনা চিকিৎসায়, ভুল চিকিৎসায় স্বজনের মৃত্যু হইলে সেই ক্ষোভ হাসপাতাল তছনছ করিয়া দেয় বটে, কিন্তু আইনি পথেও যে এই ক্ষোভের প্রশমন সম্ভব, ‘অপরাধী’-র বিচার সম্ভব, সেই কথাটি সুপ্রিম কোর্ট দ্ব্যর্থহীন ভাবে প্রতিষ্ঠা করিয়া দিল। সত্য, স্বজনবিয়োগের ক্ষতি কোটি টাকাতেও পূর্ণ হইবার নহে। কিন্তু যাহাদের অবহেলায়, ভুলে এই ক্ষতি, আইন তাহাদের কঠোর শাস্তি দিতেছে, এই ঘটনাটি স্বস্তিদায়ক বটে। অনুমান করা চলে, এই রায়ের পর আরও অনেক বেশি মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত অভিযোগে আদালতের দ্বারস্থ হইবেন। সুপ্রিম কোর্টের রায় মানিয়া যদি সত্যই হাসপাতালগুলির উপর নজরদারি বাড়ে, নথিপত্র সহজলভ্য হয়, তবে আরও অনেকেই ন্যায়বিচার পাইবেন বলিয়া অনুমান।
এই প্রসঙ্গে, দেশের শীর্ষ আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রাখিয়াও, এই প্রশ্ন উত্থাপন করা প্রয়োজন মামলার ফয়সলা হইতে দেড় দশক কি খুব বেশি সময় নহে? কুণাল সাহার জেদ ব্যতিক্রমী। অন্য অনেকেই হয়তো মাঝপথে হাল ছাড়িয়া দিতেন এবং প্রাপ্য ন্যায়বিচারের অধিকার হইতে বঞ্চিত হইতেন। দীর্ঘসূত্রতা ভারতের বিচারব্যবস্থার সর্বাপেক্ষা জটিল সমস্যা। শুধু ক্ষতিপূরণের মামলাই নহে, দেশের আদালতে বহুবিধ মামলা বকেয়া পড়িয়া আছে। বিচারব্যবস্থার আমূল সংস্কার না হইলে সেই মামলাগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি করা বা ভবিষ্যতে মামলার পাহাড় জমিতে না দেওয়া অসম্ভব। ভারতকে সেই পথে হাঁটিতে হইবে। নচেৎ, যেখানে বিচার পাওয়া সম্ভব, সেখানেও বহু মানুষকেই বিচারহীনতা মানিয়া লইতে হইবে। গণতন্ত্রে এমন পরিস্থিতি একেবারেই কাম্য নহে। |