পাকিস্তান সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ-রেখা বরাবর যাহা ঘটিতেছে, সে প্রসঙ্গে একটি কথাই বলা সম্ভব। ইহা বরদাস্ত-সীমার বহির্ভূত। যে কোনও প্রকারেই হউক, এই অবিশ্রান্ত অন্যায় আক্রমণ ঠেকাইতে হইবে। যে কোনও সার্বভৌম দেশের পক্ষেই ইহা অবশ্যপালনীয় আত্মসম্মানের প্রশ্ন। ভারতের পক্ষে আরওই বেশি। এক দিকে যখন রাশিয়া কিংবা গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের মতো বিশ্বনেতৃস্থানীয় দেশগুলির সহিত ভারত আত্মমর্যাদাসহকারে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসিতেছে, ঠিক সেই সময়েই সীমান্তরেখায় প্রতিবেশী দেশের ক্রমাগত উসকানিমূলক আগ্রাসন একেবারেই অসহনীয়। সীমান্তবর্তী ভারতীয় গ্রামগুলির অবস্থা করুণ, ভীত-সন্ত্রস্ত বাসিন্দারা দলে-দলে গ্রাম ছাড়িতেছেন, সরকার শরণার্থী শিবিরের ব্যবস্থা করিতেছে। বিরোধী দল বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারের যে তীব্র সমালোচনা করিতেছে, তাহা তাই যথেষ্ট সমর্থনীয়। তবে প্রশ্ন হইল, কোন পথে আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। কী ভাবে পাকিস্তানকে বোঝানো সম্ভব, যথেষ্ট বাড়াবাড়ি হইয়াছে, আর নহে।
বিষম ক্ষুব্ধ কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার মতও তাই। চাঁচাছোলা ভাষায় এই ধারাবাহিক হামলার নিন্দা করিয়া প্রয়োজনে ‘মুখের মতো জবাব’ দিবার হুমকি দিয়াছেন তিনি। একতরফা ভাবে কোনও দেশ যে এ ভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অসামরিক ব্যক্তিদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিঘ্নিত করিতে পারে না, দৃঢ় বক্তব্যে সে কথা মনে করাইয়া দিয়াছেন। কিন্তু তাহাতে কোনও সুফল মেলে নাই। কড়া কথা তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও উচ্চারণ করিতে হইয়াছে, যেমন হইয়াছে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকেও। তাহাতে অবশ্য পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয় নাই। অথচ পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ গত কয়েক মাস ধরিয়া ক্রমাগত ভারতের সহিত সুসম্পর্ক এবং আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীর-সহ সকল দ্বিপাক্ষিক সমস্যা মীমাংসার কথা বলিয়া গিয়াছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিবে, তবে এখন কেন তাঁহার সীমান্তরক্ষীরা ভারতীয় সীমান্তকে অশান্ত করিয়া তুলিতে এত ব্যগ্র? এই প্রশ্নের দুই ধরনের উত্তর সম্ভব। এক, সেনাবাহিনী তথা সীমান্তরক্ষীদের উপর পাক রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনও নিয়ন্ত্রণ নাই। তাহারা সেনা-কর্তাদের অঙ্গুলিহেলনেই চলিয়া থাকে। তাই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বা শুভেচ্ছার সহিত তাঁহার সেনাবাহিনী বা রেঞ্জারদের আচরণের কোনও সামঞ্জস্য ঘটিতেছে না। সেনাপ্রধান জেনারেল কায়ানি এখনও বাহিনীর দণ্ডমুণ্ডের সর্বময় কর্তা এবং তিনি ভারতবন্ধু বলিয়া পরিচিত নন। অন্য, দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি হইল, ‘কাশ্মীর তাস’ খেলার লোভ এখনও পাক শাসকরা সংবরণ করিতে পারেন না। তাই নওয়াজ শরিফ যখন ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সহিত আলোচনা ও চুক্তিতে ব্যস্ত, তখন ইসলামাবাদে তাঁহারই দলের মুখপাত্র কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মানিতে অস্বীকার করিয়া রাষ্ট্রপুঞ্জের পুরানো প্রস্তাব জিয়াইয়া তুলিয়াছেন।
সমস্যা এই যে, এই পরিস্থিতিতেও নয়াদিল্লিকে কোনও প্ররোচনার ফাঁদে পা দিলে চলিবে না। একতরফা আক্রমণ যে প্রত্যুত্তর ছাড়াই অনন্ত কাল ধরিয়া চলিতে দেওয়া হইবে না, ইহা যেমন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ইসলামাবাদকে জানাইয়া দিতে হইবে, তেমনই সীমান্তে বিপুল সেনা-মোতায়েন করিয়া রণদুন্দুভি বাজাইবার হঠকারিতা হইতেও যে কোনও ভাবে নিবৃত্ত থাকিতে হইবে। তিন-তিনটি যুদ্ধের পরেও কাশ্মীর সমস্যার কোনও নির্ণায়ক মীমাংসা হয় নাই, স্মরণ রাখা ভাল। আলোচনাই এক ও একমাত্র পথ। কিন্তু আলোচনার সহিত কঠোর অবস্থানের বিরোধও নাই। প্রতিবেশী দেশের ধুরন্ধর কূটনীতির ফাঁদের সামনে এখন নয়াদিল্লির একটিই রাস্তা খোলা: দ্ব্যর্থহীন কঠিন ভাষায়, কূটনৈতিক রশির চতুর ব্যবহারে দ্বিপাক্ষিক আলাপের দিকে প্রবৃত্ত হওয়া। |