মমতার সভা যেন খোলা হাওয়া,
পাহাড় জুড়ে বলছেন অনেকেই |
কিশোর সাহা • দার্জিলিং |
কখনও ‘ঘর ভিতরো জনতা!’ কখনও ‘ঘর বাইরো জনতা!’ প্রায় দেড় মাস ধরে এমন নানা ফতোয়ায় কার্যত দমবন্ধ একটা অবস্থায় মধ্যে যেন কাটাচ্ছিলেন পাহাড়বাসী। তাই হয়তো বৃহস্পতিবার তৃণমূলের প্রথম রাজনৈতিক সম্মেলনে সামিল হয়ে ‘মুক্ত বাতাস’ নিতে ভিড় উপচে পড়ল সকাল থেকেই।
শুধু তৃণমূলে যোগদানকারীরা নন, দার্জিলিং সদরের সাধারণ বাসিন্দাদের অনেকেই সেখানে হাজির হয়েছেন। ম্যালের চারপাশ জুড়ে টাঙানো তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শীর্ষ নেতা মুকুল রায়, উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের ছবি সম্বলিত ফ্লেক্সের সামনে দাঁড়িয়ে কৌতুহলী পাহাড়বাসীরা নানা আলোচনায় মেতেছেন।
|
|
দার্জিলিং ম্যালের সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার। |
যেমন, প্রবীণদের কয়েকজনকে বলতে শোনা গিয়েছে, “যুবক থেকে প্রৌঢ় হলাম। তিন দশকে সুবাস ঘিসিং ও বিমল গুরুঙ্গ ছাড়া কোনও নেতার ছবি দিয়ে এত ফ্লেক্স দার্জিলিং সদরে দেখিনি। এটা অবশ্যই একটা নতুন ঘটনা। এর ধারাবাহিকতা থাকলে পাহাড়ে সব দলই খোলামেলা কথা বলার সুযোগ পাবে।” আবারও কারও গলায় শোনা গিয়েছে সংশয়ের সুর, “গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে রাজ্যের বিবাদ পুরোপুরি মিটে গেলে তৃণমূল পাহাড়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেবে না তো?” সেখানে দাঁড়ানো রাজ্য মনোনীত জিটিএ সদস্য দুর্গা খোরেল, মিলন ডুকপারা তা শুনে তাঁদের আশ্বস্ত করেছেন। পাহাড়ের দুই তৃণমূল নেতার বক্তব্য, “এমন হবে না। পাহাড়ে আমরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাব। দলের নেতারা সেই নির্দেশ দিয়েছেন।”
|
|
|
দার্জিলিঙে ম্যাল এলাকার ব্যবসায়ীদের
সঙ্গে গৌতম দেব ও মুকুল রায়। |
গোটা ম্যাল এলাকা জুড়েই ছিল
উপচে পড়া ভিড়। দার্জিলিঙে। |
|
তৃণমূলের সভার দিকে নজর ছিল পাহাড়ের মোর্চা বিরোধী দলগুলিরও। রাজ্যের শাসক দলের সমাবেশে কয়েকজন খোলাখুলি মোর্চা নেতাদের সমালোচনা করায় জিএনএলএফের অনেকেই ফের মিটিং-মিছিলের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। জিএনএলএফ-এর তরফে ২৭ অক্টোবর থেকে কার্শিয়াং ও কালিম্পঙে মিটিঙের জন্য অনুমতি চাওয়া হয়েছে। নানা এলাকায় পোস্টার, ফেস্টুন, ঘিসিংয়ের বক্তৃতার সিডিও বিলি হচ্ছে। ঘটনাচক্রে, ঘিসিং কিন্তু একেবারেই সুস্থ নন। পেটের রোগের জন্য বুধবার থেকে ফের তিনি শিলিগুড়ির একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছেন। অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগ, সিপিআরএম তো বটেই, এমনকী পাহাড়ের সিপিএম নেতা-কর্মীরাও সভা-সমাবেশের কথা ভাবতে শুরু করেছেন।
|
|
বৃহস্পতিবার তৃণমূলের পতাকায় মোড়া দার্জিলিং। |
তৃণমূলের সভাকে সামনে রেখে নানা রাজনৈতিক দল পাহাড়ে সক্রিয় হওয়ায় পায়ের তলার জমি আরও খোয়ানোর আশঙ্কা করছেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার অনেকেই। একেই সাম্প্রতিক আন্দোলনে রাজ্যের চাপের ক্রমাগত পিছু হটে শেষ পর্যন্ত কোণঠাসা মোর্চা নেতৃত্ব আলোচনার বার্তা দিতে বাধ্য হন। উপরন্তু, তৃণমূলের সমাবেশ যে তাঁদের আরও ‘ব্যাকফুটে’ ঠেলে দিয়েছে সে কথা মোর্চা নেতাদের কয়েকজন একান্তে স্বীকারও করেছেন। মোর্চার অন্দরের খবর, সে জন্য তৃণমূল নেত্রীর সভার পরেই মোর্চা নেতারা তড়িঘড়ি আলোচনায় বসে আগামী ২৭ অক্টোবর চকবাজারে সমাবেশ করে পাল্টা শক্তি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরির কথায়, “আমাদের সভা হবে দার্জিলিঙের চকবাজারে। পাহাড়ের সিংহভাগ মানুষ কোন দিকে, সেখানেই অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে।” |
নরমে-গরমে মমতা |
• দার্জিলিঙের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনে জীবন দিতে পারি, কিন্তু বরবাদের চেষ্টা বরদাস্ত করব না। |
• কেউ ভুল করতে পারে। তা বলে আমি ভুল করব না। |
• বনধের জন্য যে মাইনে কাটা হয়েছিল তা ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু মনে রাখবেন আর বন্ধ নয়। |
• আমি কারও বিরুদ্ধে নই। পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে আছি। আমি পাহাড়ে প্রথমে টিএমসি তৈরি করিনি। কিন্তু এখানকার মাটি-বাতাসের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে টিএমসি। |
• যৌথ পরিবারের মতো মিলেমিশে চলতে হবে। ঝগড়া করলে হবে না। দোকান করতে হবে। মার্কেট কমপ্লেক্স বানাতে হবে। এটা জিটিএ করুক। সব সহযোগিতা করব। |
• আমি সকলকে নিয়ে চলব। মহাকাল মন্দিরে গিয়েছি। বৌদ্ধ গুম্ফায় গিয়ে প্রার্থনা করেছি, ভুটিয়াদের সঙ্গে প্রার্থনা করেছি। আমি দার্জিলিংকে ছাড়ব না। |
|
বস্তুত, তৃণমূলের এ দিনের সভায় মুখ্যমন্ত্রীর নেপালি ভাষায় সম্ভাষণ করা, কলকাতার গানের দলের নেপালি ভাষা। গান গাওয়ার পরে ম্যাল চৌরাস্তায় উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যায়। যে দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে দেখা যায় পর্যটকদেরও। বসিরহাট থেকে বেড়াতে আসা কম্পিউটার সংস্থার কর্মী সৌমিত্র দাস ও তাঁর সঙ্গীরা তো বলেই ফেললেন, “সকালে ম্যালে চা খাওয়ার জন্য রোজই আসছি। এ দিন চারদিকে ফেস্টুন, ব্যানার, ফ্লেক্স দেখে মনে হচ্ছিল যেন কলকাতায় রয়েছি।” দলের সভায় সামিল হওয়া লোকজন শুধু নন, পাহাড়ের আমজনতা, পর্যটকদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। দু’দিন ধরে তিনি কার্যত পাহাড়ে কয়েক কিলোমিটার হেঁটেই যাতায়াত করছেন। তাঁর কথায়, “পাহাড়ের মানুষের কাছে শুধু নয়, দার্জিলিঙের দিকে নজর সারা বিশ্বের। দার্জিলিংকে ঠিকঠাক সাজতে পারলে কেউ সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার কথা ভাববেন না। শুধু গরমে, পুজোর ছুটিতে নয়, সারা বছর দার্জিলিঙে পর্যটক থাকবে। দার্জিলিং হয়ে উঠবে চার্মিং অ্যান্ড স্মাইলিং।” |
ঘটনা পরম্পরা |
আশির দশক |
সুবাস ঘিসিংয়ের উত্থান। রাজনীতির মূলস্রোত থেকে মুখ ফেরাল পাহাড় |
অগস্ট, ১৯৮৮ |
বামেদের হটিয়ে পাহাড়ে কর্তৃত্বে জিএনএলএফ |
মার্চ, ২০০৮ |
ঘিসিং ক্ষমতাচ্যুত |
অক্টোবর, ২০০৭ |
গুরুঙ্গের উত্থান |
নভেম্বর, ২০০৭ |
মোর্চার হুমকিতে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সমাবেশ
দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি সরাল সিপিএম |
জুলাই, ২০১৩ |
জিটিএ গড়েও পাহাড় অচল মোর্চার |
অগস্ট, ২০১৩ |
অনির্দিষ্টকাল বন্ধের ডাক |
অক্টোবর, ২০১৩ |
ঘরে-বাইরে চাপে পড়ে রাজ্যকে আলোচনার বার্তা |
প্রায় তিন দশক বাদে মূলস্রোতের রাজনীতিতে ফেরার ডাকে সভা |
মমতার সভায় উপচে পড়ল ভিড়। দার্জিলিংকে ‘নো-স্ট্রাইক জোন’ ঘোষণার ডাক পাহাড়ের তৃণমূল নেতাদের |
|
ছবিগুলি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক ও রবিন রাই। |
পুরনো খবর: ঝগড়া করুন, কিন্তু বাগড়া নয় উন্নয়নে |
|