দার্জিলিঙের ম্যাল, নাকি কলকাতার হাজরা মোড়! বৃহস্পতিবার পাহাড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম দলীয় সভায় ভিড়ের বহর দেখে তেমনই ধন্দ জাগল। প্রায় তিন দশক বাদে মূলস্রোতের কোনও রাজনৈতিক দল সভা করল দার্জিলিঙের ম্যালে। তৃণমূলের মঞ্চে মোর্চার বেশ কিছু প্রাক্তন নেতা গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের নেতাদের দুর্নীতি এবং লাগাতার বন্ধের রাজনীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিলেন। তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য সাবধানী ছিলেন। পাহাড়ে জনজীবন স্বাভাবিক রেখে উন্নয়নের বার্তাই দিলেন তিনি। আজ, শুক্রবার, তাঁর সঙ্গে জিটিএ-র বৈঠক।
সকাল থেকেই এ দিন দার্জিলিঙের ম্যাল যেন তৃণমূলের দখলে চলে যায়। বেলা আটটার মধ্যেই সেখানে পাহাড় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা পৌঁছে গিয়ে প্রস্তুতি শুরু করেন। বেলা ১১টার মধ্যেই ম্যালে পা রাখার জায়গা মেলা ভার হয়ে ওঠে। বেলা ১২টায় সভা শুরুর মুখে ম্যালের আশেপাশে জনতার ভিড় দেখে চার দিকে টাঙানো বিশাল মাপের ফ্লেক্স খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়।
পাহাড়ের সব ক’টি মহকুমার নেতাদের পর্যায়ক্রমে বক্তৃতার সুযোগ দেওয়া হয়। কয়েক জন বক্তা মোর্চা নেতাদের নাম করে অতি মাত্রায় আক্রমণাত্মক হওয়ার চেষ্টা করলে তাঁদের সংযত করতে দেখা যায় তৃণমূলের উত্তরবঙ্গের কোর কমিটির চেয়ারম্যান গৌতম দেবকে। পাহাড় তৃণমূলের আহ্বায়ক রাজেন মুখিয়া বলেন, “আন্দোলনের নামে পাহাড়কে অচল করে রাখায় আমরা এত দিন সায় দিয়েছি। দেশের তথা রাজ্যের রাজনীতির মুলস্রোত থেকে সরে থেকেছি। বহিরাগতদের লোকসভা আসনে জিতিয়েছি। আমরা লাগাতার বন্ধ করে না খেয়ে থেকেছি। এই অবস্থার পরিবর্তন চাই।”
‘পরিবর্তন’-এর স্লোগানকে ঘিরে আশা-উত্তেজনার আবহে আজ পাহাড়ে তৃণমূলের সভা যেন পাহাড়ে রাজনৈতিক গতিপথের একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করল। গত ২৯ জানুয়ারি এই ম্যালে সরকারি সভায় গোর্খাল্যান্ডের স্লোগান উঠেছিল। তা থামাতে জনতাকে কার্যত ধমকে চুপ করিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি প্রয়োজনে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ।’ সেই মন্তব্যের জেরে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল মোর্চার সমর্থকদের মধ্যে। রাজ্য-মোর্চা বিরোধ শেষ অবধি দেড় মাসের বন্ধের চেহারা নেয় জুলাই-অগস্টে। মোর্চার মোকাবিলায় প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি পাহাড়ে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন শক্ত করতে নামে তৃণমূল। বৃহস্পতিবারের সভা তারই এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তৃণমূলের প্রথম দলীয় সম্মেলন ঘিরে পাহাড়ি মানুষের উদ্দীপনা থাকলেও তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সতর্ক। পাহাড়ের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, “আমি কারও বিরুদ্ধে নই। পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে আছি। আপনারা কোনও দিন বাংলাকে ছাড়তে পেরেছেন? আমরা কোনও দিন আপনাদের ছাড়তে পারব?” তাঁর বার্তা, ঝগড়া না করে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাড়াতাড়ি কাজ করতে হবে। জনজীবন স্বাভাবিক রেখে উন্নয়ন করতে হবে।
দলনেত্রী সতর্ক থাকলেও, এ দিনের সভায় গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন বেশ কিছু বক্তা। সদ্য জিএনএলএফ এবং মোর্চা ছেড়ে আসা রাজেন মুখিয়া, ননিতা গৌতম, আপ্পা রাজনদের অভিযোগ, গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের নামে সাধারণ পাহাড়বাসীকে রাস্তায় নামিয়ে কিছু নেতা ধনসম্পত্তি বাড়িয়েছেন। প্রথমে সুবাস ঘিসিং ও পরে বিমল গুরুঙ্গের ডাকে নানা আন্দোলনে সাড়া দিয়েও দেখা গিয়েছে, এই নেতারা পাহাড়ের উন্নয়নে মনোযোগী নন। আগে গোর্খা পার্বত্য পরিষদ ও পরে জিটিএ হাতে পেয়েও তাঁরা পাহাড়বাসীর স্বার্থে কাজ করেননি। তাঁদের আশা মমতার নেতৃত্ব মেনে নিলে পাহাড়ে বন্ধ, হুটহাট ফতোয়ার রাজনীতির দিন ফুরোবে।
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর আধ ঘণ্টার বক্তব্যে একবারের জন্যও মোর্চা নেতাদের নাম করে কোনও সমালোচনা করেননি। তবে ফের পাহাড়ে অচলাবস্থার চেষ্টা হলে তিনি যে আরও কঠোর হয়ে উঠবেন, সেটা স্পষ্ট করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “মিলেমিশে কাজ করতে হবে। সারা বছর যাতে পাহাড়ে পর্যটক আসে তা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা শীঘ্রই পাহাড়ে রাজ্য সংস্কৃতি উৎসব করব। আমার সোজা কথা, কেউ ভুল করতে পারে। তা বলে আমি ভুল করব না।” তিনি আবারও দার্জিলিংকে ‘বাংলার হৃদয়’ বলে উল্লেখ করতে ভোলেননি।
মোর্চার তরফে রোশন গিরি এ দিন জানান, “পরিস্থিতি বিষয়ে আমরা ওয়াকিবহাল। আগামী ২৭ তারিখ দার্জিলিঙের চকবাজার এ সভা হবে। সেখানে দলের সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।”
|