শীতের মরসুম আসার আগে বাজারে সব্জির দাম কমবে, আশা ছিল সকলের। কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলেছে দফায় দফায় বৃষ্টি। ফলন নষ্ট হয়েছে প্রচুর পরিমাণে। অনেক ক্ষেত্রে চাষ শুরুই করতে পারছেন না চাষিরা। কৃষি বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, কয়েক দিনের মধ্যে বৃষ্টি বন্ধ না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
দিন পনেরো আগে বর্ষা বিদায় নিলেও আকাশের মুখ ভার গোটা দক্ষিণবঙ্গে। আবহাওয়া দফতর সূত্রের খবর, পিলিনের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই অন্ধ্র উপকূলে ফের নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে। যার জেরে বৃষ্টি চলছে জেলায় জেলায়। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতির আশা নেই বলেই জানিয়েছে আবহাওয়া দফতর।
ফলে এই সময়ে রবি শস্য বোনার উপযুক্ত মাটিই তৈরি করতে পারছেন না কৃষকেরা। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃষ্টি বেশি হওয়ায় মাটিতে জলের স্তর অনেকটাই বেড়ে রয়েছে। দীর্ঘ বর্ষা ও পর পর নিম্নচাপের জেরে মাটি শুকনো হওয়ার সময় মিলছে না। ফলে বীজ থেকে চারা তৈরির করে তা বোনার জায়গা করতে পারছেন না কৃষকেরা। টোম্যাটোর চারা তৈরির সময়েই ধসা রোগ হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে, ফুলকপি-বাঁধাকপির মতো শীতের সব্জিও।
হুগলিতে বৃষ্টি ও বন্যায় ৬৭২.৩ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সব্জিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা কৃষি দফতর সূত্রের খবর। ধনেখালির চাষি কাশীনাথ পাত্র এ বার পেঁয়াজ ও ফুলকপি চাষ করেছিলেন। জানালেন, ২ বিঘে জমিতে জল দাঁড়িয়ে পেঁয়াজের গোড়া পচে যাচ্ছে। ১০ কাঠা জমির ফুলকপিও ক্ষতির সম্মুখীন। তারকেশ্বরের বিনোদ দাসেরও অভিজ্ঞতা প্রায় এক। তাঁর দেড় বিঘা জমির মূলো চাষ অতিবৃষ্টিতে পুরোটাই নষ্ট হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে পেঁয়াজ, ফুলকপিরও। হাওড়ার আমতা ও উদয়নারায়ণপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যায় ক্ষতি হয়েছে সব্জি চাষে। |
তার উপরে ফড়েদের উৎপাত। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের টালিভাটার সব্জি চাষি লক্ষ্মণ সাঁতরা যেমন জানান, বৃহস্পতিবার তিনি ফড়েদের ঝিঙে প্রতি কেজি ২০-২৫, উচ্ছে ২৫, বেগুন ৩০ ও শশা ৭ টাকায় বিক্রি করেছেন। কিন্তু এলাকারই বাজারে ঝিঙে ৪০, বেগুন ৬০, উচ্ছে ৪৫ টাকায় বিকোচ্ছে। এতটা ফারাক কেন? দাসপুরের এক আড়তদার সন্তোষ পাল বলেন, “চাষিদের কাছে ফসল কিনে মুটে দিয়ে তা বস্তাবন্দি করে গাড়িতে বিভিন্ন বাজারে পাঠাতে হয়। এটুকু খরচ হয়েই যায়।”
সর্বত্রই চাষিদের বক্তব্য, সরকার টাস্ক ফোর্স গড়ে বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। কিন্তু পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে ফলন কমবে। সরকার তখন কী পদক্ষেপ করে দামের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখে, সেটাই দেখার।
কয়েকটি জেলায় বন্যা ও অতিবৃষ্টির জেরে রাজ্যের প্রায় ৪ লক্ষ ৭০ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটকও। মঙ্গলবার তিনি বলেন, “ইতিমধ্যেই রাজ্যের রবি ফলনের বেশ ক্ষতি হয়েছে। আগামী দিন পনেরোর মধ্যে বৃষ্টি কমে রোদ না উঠলে যে ৩০% ফসল বাঁচানো গিয়েছিল, তা-ও নষ্টর আশঙ্কা রয়েছে।” এর মধ্যে কিছুটা আশার কথা শোনান মন্ত্রী। বলেন, “তাজা সব্জির জন্য আবারও বীজ পুঁতে ফলন করার সময় এখনও হাতে রয়েছে।”
কৃষি বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য বলছেন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, দেশি টোম্যাটো, বেগুন বা পালং শাকের মত সব্জিগুলি তৈরি হতে কম করে ৫০ দিন লাগে। বৃষ্টি থামার পরে মাটি শুকনো হলে তবে বীজ লাগিয়ে চারা করতে হবে। তারপর ফলন পেতে পেতে ডিসেম্বর-জানুয়ারি হয়ে যাবে। ফলে এই দু’মাস বাজারে সব্জির চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ফারাক থাকবেই। যার জেরে দামও চড়া থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানপালন বিভাগের ডিন প্রণব হাজরা বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ জমিকেই আমরা মিডিয়াম ল্যান্ড (যে সব জমির উচ্চতা খুব বেশি নয়) বলি। বৃষ্টি বেশি হওয়ায় এখনও এই সব জমিতে জল দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই জমিতে ফসল হবে কী করে? জলের মধ্যে চারা বুনলে ধসা রোগে আক্রান্ত হবে।” হুগলিতে আলু চাষেরও ক্ষতি আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান প্রণববাবু।
কিন্তু বীজ তৈরির ক্ষেত্রে কৃষিবিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তা-ও কেন এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না? মোহনপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন গবেষক অমিত চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বীজ যা-ই হোক না কেন, প্রতিকূল আবহাওয়া হলে কিছু কাজ করবে না।” অমিতবাবুর বক্তব্য, “বীজ উন্নত করে ফসল তৈরির সময় কমানো যায়। গুণাগুণ পরিবর্তন করা যায়। জাত পাল্টানো যায়। কিন্তু গাছ বাঁচবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করে আবহাওয়ার উপরেই।”
এই অবস্থায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন বহু চাষি। নদিয়ার চাষি বিভাস পাল বলেন, “শীতের সব্জির আশায় থেকে আর লাভ নেই। আমরা তাই ঢ্যাঁড়শ, পটল, লঙ্কার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি।” নদিয়া জেলায় সব থেকে বেশি সব্জি চাষ হয় চাকদহ ও হরিণঘাটা ব্লকের মদনপুর ও সংলগ্ন এলাকায়। মদনপুর পাইকারি বাজারে দেখা গেল, চাষিরা ব্যবসায়ীদের কাছে ছোট ফুলকপি বিক্রি করছেন ৫ টাকা দামে। বড় ফুলকপি ১৫-২০ টাকা। স্থানীয় বাজারে ক্রেতারা সেই ফুলকপি কিনছেন ২০-২৫ টাকা দরে। পাইকারি বাজারে চাষিরা ব্যবসায়ীদের কাছে বেগুন বিক্রি করছেন ২৫-৩০ টাকা কেজিতে। বাজারে তা ৩৫-৪০ টাকায়। প্রতি কেজি পালং শাক ব্যবসায়ীরা চাষিদের থেকে কিনছেন ৪০-৫০ টাকায়। বাজারে তা ৫০-৬০ টাকা। বর্ধমানে সব থেকে বেশি সব্জি চাষ হয় পূর্বস্থলীতে। এখানকার কালেখাঁতলা পাইকারি বাজারে চাষিরা ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতিটি ফুলকপি বিক্রি করছেন ১০-১৫ টাকায়। কালনার বাজারে ক্রেতারা তা কিনছেন ২০-২৫ টাকায়। প্রতি কিলোগ্রাম বাঁধাকপি বিক্রি করে চাষিরা পাচ্ছেন ২০ টাকা। ক্রেতারা বাজারে তা কিনছেন ৩০ টাকা দরে। পাইকারি বাজারে চাষিরা ব্যবসায়ীদের কাছে উচ্ছে বিক্রি করছেন কেজি প্রতি ৩৫-৪০ টাকায়। বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়।
একে ফলন কম, তার উপরে ফড়েদের হাত ঘুরে দর বেড়েই চলেছে বাজার দর। এই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো পরিকাঠামো স্থায়ী রাজ্য সরকারের নেই। বাজারে বাজারে ঘুরে নজরদারি করে দামের উপরে কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে রাজ্য, আপাতত ক্রেতাদের নজর সে দিকেই।
|