বৃষ্টিতে জল জমে সব্জি চাষে ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি বাড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষতি বা আশঙ্কাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাজারে আগুন লাগানোর কৌশল নিয়েছে ফড়েরা। চাষি যে দরে ফড়েদের কাছে সব্জি বেচছেন, তার থেকে তিন বা চার গুণ বেশি দামে সে সব্জি বিকোচ্ছে কলকাতা বা শহরের উপকণ্ঠের বাজারে। সেখানে সব্জির আগুন দরে হাতে ছ্যাঁকা লাগছে গৃহস্থের।
জল এত দূর গড়িয়েছে যে ৬ সেপ্টেম্বর বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট টাস্ক ফোর্সের বৈঠক ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে সব্জি বাজারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা হবে। ভাদ্রের প্রথম সপ্তাহে টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার সব্জি-চাষিরা সমস্যায় পড়েছেন। উদ্যান দফতরের ডিরেক্টর পীযূষকান্তি প্রামাণিক বলেন, “প্রতিটি জেলা আধিকারিকের কাছে ক্ষয়ক্ষতির হিসেব চাওয়া হয়েছে। কয়েকটি জেলা থেকে রিপোর্ট এসেছে। ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়াবে বলে মনে হচ্ছে।” মহাকরণের খবর, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় সব্জিচাষের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।
হুগলির সিঙ্গুর, হরিপাল, ধনেখালি, তারকেশ্বর, বলাগড়-সহ বিভিন্ন জায়গায় সব্জি চাষ হয়। উদ্যান দফতর সূত্রের খবর, বৃষ্টি না থামলে শশা, উচ্ছে, করলা, পটল, লাউ, পুঁইশাকের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। গাছের গোড়ায় জল দাঁড়ালে বেগুন বা লঙ্কারও ক্ষতি হবে। হুগলির শিবাইচণ্ডীর লক্ষ্মীকান্ত মালিক ১৫ কাঠা জমিতে বেগুন ও ধনেপাতা চাষ করেছেন। তিনি বলেন, “এই কিছু দিন আগেই টানা বৃষ্টি হয়ে গেল। এখন ভাল রোদ না হলে চাষের ক্ষতি হবে।” ধনেখালির কানা নদী এলাকার উৎপল সাঁতরা বলেন, “দেড় বিঘে জমিতে জলদি ফুলকপি চাষ করছি। জমিতে জল দাঁড়ালে বেজায় সমস্যায় পড়ব।”
এই অবস্থায় চাষিরা গড়ে ৬০-৬৫ টাকা পাল্লা (পাঁচ কেজি) দরে লঙ্কা, পটল, করলা, লাউ, পেঁপে, শশা, ঝিঙে বিক্রি করছেন ফড়েদের কাছে। দু’তিন হাত ঘুরে তা যখন মানিকতলা বা হাতিবাগান বাজারে আসছে তখন দর দাঁড়াচ্ছে (কিলো প্রতি) লঙ্কা ১০০ টাকা, পটল ৪০, করলা ৪০, লাউ ৩০, পেঁপে ৪০, শশা ৪০, ঝিঙে ৩০ টাকা। হাতিবাগান বাজারে নিয়মিত যান খন্না এলাকার প্রদীপ দাস। তাঁর বক্তব্য, “দোকানি বলছে, মাঠে জল হয়েছে। সব্জি পচে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। পটল, লঙ্কার ক্ষেত্রে তেমন হতেও পারে। পেঁপে, লাউয়ের দাম কী যুক্তিতে বেশি হবে? ওগুলো তো আর জমিতে জমা জলে নষ্ট হয় না।”
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ফড়ের বক্তব্য, “গ্রাম থেকে শহরে সব্জি আনতে পরিবহণ খরচ বেড়েছে। বেড়েছে রাস্তায় কাঁচা সব্জির গাড়ি আটকানো নানা মহলকে পয়সা দেওয়ার চাপ। সব্জির দাম না বাড়ালে পোষাবে কী করে!”
ক্ষমতায় এসেই খুচরো বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দামের ফারাক মেটাতে চেষ্টা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সরকারি ভাবে মুরগি, মাছ, পেঁয়াজ, আদা বিক্রি করা হয়েছে গৃহস্থের পকেটের কথা মাথায় রেখে নিয়ন্ত্রিত দামে। কিন্তু খুচরো বাজারে সব্জির দামের ওঠাপড়া নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারি কর্তাদের। সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায়। তাঁর কথায়, “বিভিন্ন দফতরে সমন্বয় করে বাজারে নিয়মিত নজরদারি চলে। বৃষ্টির জন্য ক্ষতির কথা বলে কোথাও কোথাও যে সব্জির চড়া দাম নেওয়ার খবর আমাদের কাছেও আছে। খবর পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
রাজ্য কৃষি বিপণন পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা নরেন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, “কৃষিপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী চেষ্টা করছেন বা সময় দিচ্ছেন, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সরকারি দফতরগুলির ব্যর্থতায় বাজারে সব্জির দাম বাড়িয়ে মুনাফা লোটার চেষ্টা করছে ফড়েরা।”
সরকারি কর্তাদের একাংশও মানছেন দাম নিয়ন্ত্রণ এবং নজরদারির বিষয়টি এখনও আটকাচ্ছে লাল ফিতের ফাঁসে। সরকারি দাম নিয়ন্ত্রণকারী টাস্ক ফোর্সের এক কর্তা বলেন, “কৃষি দফতর, উদ্যানপালন দফতর, কৃষি বিপণন দফতরের কর্তাদের মধ্যে প্রত্যাশিত সমন্বয় নেই। ফাইল চালাচালি করতেই বছরের অর্ধেক সময় লেগে যায়। কেন্দ্রীয় কৃষি দফতরের আদলে সব কিছু একছাতার তলায় আনা হলে বাজারে নিয়ন্ত্রণ রাখা অনেকটাই সম্ভব হবে। তত দিন পর্যন্ত ক্রেতারা ভুগবেন।”
থলি হাতে বেজার মুখে বাড়ি ফিরছিলেন মৌলালির সৃজন কুমার। বললেন, “পাঁচমেশালি তরকারি খাওয়ার ইচ্ছে ছিল। পটল, কুমড়ো কিনতে গিয়েই পকেটে যা ছিল বেরিয়ে গেল। এ ভাবে আর কত দিন চলবে!” |