|
|
|
|
সরকারি গাড়িই বিষাইছে বায়ু, রাজ্য উদাসীন |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বেলা সাড়ে ১২টা। পুলিশের নাকের উপরে গলগল করে কালো ধোঁয়া ছেড়ে পার্ক সার্কাসের চার নম্বর সেতুর দিকে চলে গেল জিপটি। নম্বর ডব্লুএমই ১২৩৭। সামনে লেখা ‘গভর্নমেন্ট অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’।
বেলা পৌনে ১০টায় প্রায় একই কাণ্ড বাগবাজার মোড়ে। কাশীপুরের দিক থেকে আসা একটি সরকারি বাস কালো ধোঁয়ায় রাস্তাঘাট অন্ধকার করে দিয়ে চলে গেল। রাস্তার পুলিশকর্মী দাঁড়িয়ে রইলেন দর্শক হয়ে।
বায়ুদূষণকে ক্যানসারের অন্যতম কারণ হিসাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র সিলমোহর লাগানোর ৪৮ ঘণ্টা পরে, শনিবারের কলকাতা ছিল এ রকমই। শহরের এই চিত্র অবশ্য এই এক দিনের নয়, রোজকারই। শহরবাসীর অভিজ্ঞতা বলছে, বায়ুদূষণের অন্যতম বড় কারণ যে যানবাহনের ধোঁয়া, তার একটা বড় অংশই আসছে সরকারি গাড়ি থেকে। কলকাতা পুলিশের যে শাখাটি দূষণ পরীক্ষা করে, তাদের তথ্যও বলছে সরকারি গাড়ি, ডিজেল চালিত ট্যাক্সি ও মালবাহী গাড়ি সব চেয়ে বেশি দূষণ ছড়াচ্ছে।
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছা কতটা? একটি উদাহরণেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “আমাদের তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালে সরকারি কোনও যানবাহনের বিরুদ্ধে দূষণ ছড়ানোর অভিযোগে মামলা করা হয়নি। অথচ সবাই দেখছেন, সরকার ও পুরসভার যানবাহনই সব চেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়। নিজেদের গাড়ির ব্যাপারেই যদি সরকারি কর্তারা এতটা উদাসীন হন, তবে মানুষকে আর কী বলা হবে?”
এ ব্যাপারে কী বলছে রাজ্য সরকার? পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্রের জবাব, “৩৪ বছরের জঞ্জাল তো রাতারাতি সাফ করা যায় না।” একই সঙ্গে মন্ত্রীর দাবি, “আগের চেয়ে ২০ শতাংশ হলেও উন্নতি হয়েছে দূষণ নিয়ন্ত্রণের। সরকারি বাস থেকে এখন আর আগের মতো চোখ জ্বালা করা ধোঁয়া বেরোয় না।”
বায়ুদূষণ রোধে কী করছে সরকার? কলকাতা পুলিশের দাবি, প্রতিদিন শহরের দু’-তিন জায়গায় দূষণ পরীক্ষার গাড়ি অভিযান চালায়। প্রতিদিন গড়ে ৬০টির বেশি গাড়িকে দূষণ আইন ভাঙার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়।
কিন্তু এত কম গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করে যানবাহনের দূষণ কতটা কমনো যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তাঁদের বক্তব্য, শহরের ১৮৫ বর্গ কিমি এলাকায় রাস্তা রয়েছে ১ হাজার ৮৭০ কিমি। এই রাস্তায় প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৭ লক্ষ গাড়ি চলে করে। পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, কলকাতায় ফি বছর গড়ে ২৩ হাজার করে নতুন গাড়ি নথিভূক্ত হচ্ছে। এর একটি বড় অংশই ডিজেল চালিত গাড়ি। তাই দূষণ বাড়ছে। এর মধ্যেই তাই দেশের শহরগুলির মধ্যে দূষণে এক নম্বরের শিরোপা পেয়ে গিয়েছে কলকাতা। এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার মতো সচেতনতা নেই প্রশাসনের কর্তাদের।
এই কারণেই কলকাতা পুলিশের ‘অ্যান্টি পলিউশন সেল’-এ কর্মী রয়েছেন মাত্র ২৯ জন। এর মধ্যে এক জন ইনস্পেক্টর-সহ সাত জন অফিসার। বাকিরা কনস্টেবল। গাড়ি রয়েছে তিনটি। প্রশাসনের বক্তব্য, আর যাই হোক এত কম কর্মী দিয়ে লক্ষ লক্ষ গাড়ির দূষণ পরীক্ষা সম্ভব নয়।
এ তো গেল কলকাতা পুলিশের অধীনস্থ এলাকার কথা। শহর লাগোয়া এলাকায় কী ঘটছে?
রাজ্যের ‘পাবলিক ভেহিকলস ডিপার্টমেন্ট’-এর এক কর্তা জানান, হাওড়া এবং দুই ২৪ পরগনার শহর এলাকায় গাড়ির দূষণ মাত্রা পরীক্ষা করার জন্য তাঁদের একটি মাত্র ভ্রাম্যমান গাড়ি রয়েছে। দূষণ-মাত্রা লঙ্ঘনের দায়ে ওই বিভাগ গড়ে প্রতি মাসে এক হাজার গাড়ির বিরুদ্ধে জরিমানা করে। ওই বিভাগের এক কর্তার মতে, কলকাতা হাওড়া ও দুই ২৪ পরগনার শহর অঞ্চলে একটি মাত্র একটি ভ্রাম্যমান গাড়ি দিয়ে দূষণ পরীক্ষা করা কার্যত অসম্ভব। অবিলম্বে এই ধরনের গাড়ির সংখ্যা না বাড়ালে কাজের কাজ কিছুই হবে না।
অর্থাৎ, এখানেও সেই ঢাল তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দারদের দিয়েই দায়সারা গোছের কাজ চালানো হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যা-ই বলুক, আপাতত প্রশাসনের নিদ্রাভঙ্গ হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
|
বাতাসের বিষ কমানোর উপায় |
কী |
যা আছে |
কেমন হওয়া উচিত |
জ্বালানি |
সালফার এবং সিসামুক্ত
জ্বালানির আংশিক ব্যবহার |
নিম্নমানের জ্বালানি
বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা |
ইঞ্জিন |
ইউরো-৪-এ এখনও আটকে
রয়েছে। এই ইঞ্জিন সম্পূর্ণ নিরাপদ নয় |
বাজারে আছে ইউরো-৮ যা
জ্বালানিকে পুরোপুরি পুড়িয়ে ফেলে |
বিকল্প জ্বালানি |
ব্যাটারির ব্যবহার নগণ্য। অটো ছাড়া
অন্য যানবাহনে এলপিজি ব্যবহার
হয় না। এলপিজির জোগানও কম |
ব্যাটারি বা এলপিজি-র ব্যবহার বৃদ্ধি |
রাস্তা |
শহরের আয়তনের মাত্র ৬% রাস্তা।
ভাঙাচোরা পথ। ফলে
গাড়ির গতি গড়ে ১৮ কিমি |
গাড়ির গতি বাড়াতে শহরের আয়তনের
২০-৩০% রাস্তা তৈরি। ফ্লাইওভার
বানানো, রাস্তা চওড়া ও হকারমুক্ত করা |
গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ |
ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে রাশ নেই।
গণপরিবহণ ব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি |
নানা ভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে রাশ।
উন্নতমানের গণপরিবহণের ব্যবস্থা করা |
ঋণ : পুলক লাহিড়ী (বিশেষজ্ঞ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়), অনুপম দেব সরকার (বিশেষজ্ঞ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) |
|
পুরনো খবর
• বাতাসেরই বিষকণায় ক্যানসার, দূষণ-শীর্ষ কলকাতা এখন ত্রাস
• উদাসীনতায় ঠোক্কর খেয়েই ভোঁতা দূষণ-যুদ্ধের হাতিয়ার |
|
|
|
|
|