|
|
|
|
ঠিক মিলবে সোনা, অটল বিশ্বাস স্থানীয়দের |
অনমিত্র সেনগুপ্ত • উন্নাও (উত্তরপ্রদেশ) |
সোনা আদৌ মিলবে কি না, জানা নেই। ডৌড়িয়া খেড়া তবু বিশ্বাসে অটল। তাদের বক্তব্য, আজ হোক বা কাল, ঠিকই মিলবে সাধু শোভন সরকারের ভবিষ্যদ্বাণী।
আর সেই বিশ্বাসে হাওয়া দিয়েছে জিওলজিক্যাল সার্ভের একটি রিপোর্ট। জিএসআই-এর সেই রিপোর্ট বলছে, চিহ্নিত স্থানে জমি থেকে ৫ থেকে ২০ মিটার গভীরে ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে। যার চৌম্বক ধর্ম নেই। এবং স্থানীয় ভূ-প্রাকৃতিক চরিত্রের সঙ্গে তা কোনও ভাবেই খাপ খায় না।
ধাতু অথচ চুম্বক ধর্ম নেই। অর্থাৎ রাজবাড়ির অস্ত্রাগার বা লোহা নয়। তা হলে কি সোনা? না অন্য কিছু?
খননের দায়িত্বে থাকা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই)-এর কর্মীদের মুখে কুলুপ। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাসই শুধু যে প্রবল, তা নয়। খোঁড়ার নির্দেশ যেখানে এসেছে খোদ কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী চন্দ্রেশ কাটোচের পক্ষ থেকে, সেখানে আলটপকা কিছু বলে বিতর্কের মুখে পড়তে চান না কেউই। কিন্তু মাটির নীচে কিছু যে রয়েছে, তা স্বীকার করছেন এএসআই কর্মীরাও। কারও মতে, রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যেতে পারে মাটি খুঁড়ে। কিন্তু ধাতুর উপস্থিতি? তা নিয়ে এখনই মন্তব্যে নারাজ সংস্কৃতি মন্ত্রক।
স্থানীয় মানুষের কিন্তু অন্য কিছু ভাবতে বয়েই গিয়েছে। তাঁদের অনেকেরই দৃঢ় বিশ্বাস, ‘বাবা’-র কথা ফলতে বাধ্য। শুধু ঠিকঠাক খুঁড়তে হবে। তা হলেই পাওয়া যাবে সোনা। সাধুর স্বপ্নের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ডৌড়িয়া খেড়া গ্রামে হার মেনেছে সমস্ত যুক্তি-তর্ক-বিজ্ঞান। গ্রামবাসীদের বক্তব্য, রাজা রাওয়ের ইচ্ছা ও ত্রিকালজ্ঞ বাবার স্বপ্ন কখনওই ব্যর্থ হতে পারে না। আর তাই পুলিশি উপস্থিতিকে পাত্তা না দিয়ে আজও সকাল থেকে ভিড় জমেছে খননস্থলের চৌহদ্দিতে। |
|
শিবমন্দির চত্বরে দেখা হয়ে গেল গ্রামপ্রধান অজয় পাল সিংহের সঙ্গে। মাটির তলায় ধাতুর উপস্থিতির কথা তুলতেই বললেন, “আরে আমরা তো জানিই এখানে সোনা রয়েছে। কোথায় রয়েছে, শুধু সেটাই জানি না। স্বাধীনতার আগেও এক বার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তা ভেস্তে যায়। আসলে রাজা রামরাও বক্স সিংহ দিনরাত পাহারা দিচ্ছেন নিজের খাজানা। তিনি না চাইলে কেউ তা হাতে পাবে না।” ডৌড়িয়া খেড়া গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার দূরেই বক্সার মোড়। যাওয়া-আসার পথে চোখে পড়ে সেই চৌমাথায় হাতে তরোয়াল নিয়ে ঘোড়ার উপর আসীন রয়েছেন রাওসাহেব। অজয় সিংহ বলেই চলেন, “স্থানীয়রা রাত-বিরেতে অনেকেই রাজাকে দেখেছেন ঘোড়ায় করে কেল্লা চত্বরে পাহারা দিতে। মৃত্যুর পর যখ হয়ে তিনি নিজেই আগলে বসে আছেন নিজের সোনা।”
এটুকুতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না অখ্যাত এই পরগনার ওই সিপাহি বিদ্রোহের সেনাকে নিয়ে গল্পকথা। পাশের গ্রামের বাসিন্দা তথা শোভন সরকারের শিষ্য বৃন্দাবন দ্বিবেদীর আবার দাবি, “কেল্লা সংলগ্ন জঙ্গলে থাকা কামেশ্বর মহাদেবের মন্দিরে আজও সূক্ষ্ম শরীরে প্রাত্যহিক পুজা-অচর্না করতে আসেন রাওসাহেব।” তাঁর দাবি, যে যত সকালেই আসুক, দেখা যাবে আগেই সেখানে পুজো সারা।
এক দিকে রাওসাহেবকে নিয়ে পাল্লা দিয়ে গুজব। অন্য দিকে, ডৌড়িয়া খেড়ার পর এ বার অন্তরাল থেকে শোভন সরকার আরও একটি বোমা ফাটিয়েছেন। দাবি করেছেন, রাজ্যের অন্যত্রও মাটি খুঁড়লে সোনা পাওয়া যাবে।
ইতিমধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব, তর্ক-যুক্তির লড়াইয়ে শোভন সরকারের যে ভক্তরা কাল সামান্য পিছিয়ে পড়েছিলেন, তাঁরাই আজ জিএসআই-এর রিপোর্টকে হাতিয়ার করে তেড়েফুঁড়ে ময়দানে নেমেছেন। তাঁর শিষ্য ওম আজ ফের দাবি করেছেন, “বাবার কথা ফলবেই। শুধু ডৌড়িয়া খেড়া-ই নয়। যেখানে যেখানে বাবা দাবি করেছেন, সোনা পাওয়া যাবে সে সব জায়গাতেও।”
কী দাবি করেছেন বাবা?
শিষ্য ওমের দাবি, বাবা ইতিমধ্যেই ফতেপুরের জেলাশাসককে চিঠি দিয়েছেন। সেই চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, ডৌড়িয়া খেড়া থেকেও বেশি সোনা আদমপুর গ্রামে মাটির তলায়। শোভনের দাবি, ওই এলাকায় মাটির নীচে প্রায় আড়াই হাজার টন সোনা রয়েছে। উন্নাওয়ে সোনা খুঁড়তে প্রায় ৬০ ফুট গভীর পর্যন্ত খনন করতে হলেও ওই এলাকায় ১০-১৫ ফুট খুঁড়লেই হবে। মিলবে সোনার দেখা। এই কথা ছড়িয়ে পড়তে ওই এলাকায় একটি প্রাচীন শিবমন্দির চত্বরে এক দল লোক খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে দেয়। স্থানীয় বাসিন্দারা গিয়ে তাদের আটকান। শুধু ওই দু’টি জায়গায় নয়, শোভনের দাবি, সোনা রয়েছে কানপুরেও। সেখানকার জেলাশাসককে লেখা চিঠিতে শোভন জানিয়েছেন, কানপুরের প্যারেড গ্রাউন্ডে ও চৌবেপুরে মাটির নীচে সোনা রয়েছে। গুপ্তধনের এই হাওয়া উত্তরপ্রদেশ ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ছে রাজস্থানেও। দাবি উঠতে শুরু করেছে, সেখানেও অনেক দুর্গের মাটি খুঁড়লে মিলবে সোনা।
স্বপ্নাদেশে ভর করে যে ভাবে সরকারের তরফে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করা হয়েছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে সমালোচনাও। গোটা দেশের যুক্তিবাদী মঞ্চগুলিই শুধু নয়, প্রতিবাদ করেছেন অনেক প্রাক্তন এএসআই কর্তাও। সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপিও। কিন্তু শিষ্য ওম সে সব শুনতে রাজি নয়। তাঁর সাফ কথা, “শোভন মহারাজ্যের দিব্যদৃষ্টি রয়েছে। তার ভিত্তিতেই তিনি সোনা দেখতে পেয়েছেন। সুতরাং অপেক্ষা করুন।”
তাঁর দিব্যদৃষ্টির জোর কতটা, তা প্রমাণে শোভন সরকার প্রশাসনের কাছে দশ লক্ষ টাকা জমা রাখার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন। সোজা কথায় যাকে জামানত বলা যেতে পারে।
তাঁর দেখানো জায়গায় সোনা পাওয়া না গেলে ওই টাকা সরকারি কাজে ব্যবহার করা এবং শাস্তি হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু যে ভাবে এখন নানা জায়গা থেকে গুপ্তধনের খবর আসতে শুরু করেছে, তাতে অস্বস্তিতে খোদ এএসআই কর্তারা। খননে যুক্ত এক কর্তার বক্তব্য, “গতিক সুবিধার নয়। রকম দেখে মনে হচ্ছে, এর পরে সোনার খোঁজে সারা দেশের মাটি খুঁড়ে বেড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোনও কাজ থাকবে না!”
|
পুরনো খবর: অখ্যাত উন্নাও যেন সোনার কেল্লা, স্বপ্নাদেশ নিয়েই শুরু খনন অভিযান |
|
|
|
|
|