বাঁ হাতে বরণের থালাটা ধরা। থালার উপর পানপাতার পাশে রাখা রুপোর কৌটো থেকে এক মুঠো সিঁদুর তুলে দুর্গাপ্রতিমার কপালে-গালে লাগিয়ে দিলেন পূর্ণিমাদি। তার পর ডান হাতে প্রতিমা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব পূর্ণিমাদিকে উঁচু কাঠের বেঞ্চ থেকে ধরাধরি করে নামানোর পরেও সামলানো যাচ্ছিল না। টুকটুকে ফর্সা মুখ কান্নার দমকে লাল হয়ে গিয়েছে। কাঁদতে-কাঁদতেই বলছিলেন, “মা চলে যাওয়ার আগে আমাদের সিঁদুর পরার অধিকার দিয়ে গেলেন। ভাবিনি এ জীবনে এই সম্মান কখনও পাব।”
এই প্রথম দশমীতে সিঁদুর খেলল সোনাগাছি। প্রতিমার কপাল থেকে নেওয়া সিঁদুর একে-অন্যের মাথায় লাগিয়ে সামাজিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অনেকটা পথ যেন এগিয়ে গেলেন যৌনকর্মীরা। দুর্গাপুজোর প্রতীকী মাতৃশক্তির আরাধনার সঙ্গে শুরু হল প্রান্তিক যৌনকর্মীদের অভিকারলাভের নতুন অধ্যায়। |
প্রথম বার সিঁদুর খেলা আর ধুনুচি নাচে। সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি। |
সোনাগাছিতেই জীবনের প্রায় তিরিশ বছর কাটিয়ে দেওয়া ভারতীদি, স্বপ্নাদি, মালতীদি, অনিমাদিদের কথায়, তাঁরা এতদিন ছিলেন আত্মপরিচয়হীন ত্রিশঙ্কুর মতো। না সধবা, না বিধবা। বাবুদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং সংসারকে স্বীকৃতি দেয়নি বাইরের সমাজ। তথাকথিত ভদ্রলোকেদের পুজোয় সিঁদুর খেলতে গেলে প্রাপ্য ছিল ব্যঙ্গ আর কটূক্তি। সোনাগাছিতে এই প্রথম তাঁদের দুর্গাপুজো বাবুদের সঙ্গে তাঁদেরই স্বীকৃতিহীন সম্পর্ককে কার্যত শিলমোহর দিল।
নিজেদের পুজোর অধিকার চেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন যৌনকর্মীরা। শেষ মুহূর্তে জয় হয়েছে তাঁদের। পুজোর পরিসর ছিল ছোট, কিন্তু গুরুত্ব অপরিসীম। সুচারু ভাবে সবকিছু সম্পন্ন করার দায়িত্ব ছিল যৌনকর্মীদের কাঁধে। পঞ্চমীর দিন অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিটের দুর্বার ক্লিনিকে প্রতিমা আসার পর থেকে দু’চোখের পাতা বন্ধ করার সময় ছিল না তাঁদের। এক দিকে পুজোর সময়ে বাড়তি খদ্দের সামলানো, অতিরিক্ত চার পয়সা রোজগারের ব্যবস্থা করা। অন্য দিকে, পুজোর যাবতীয় আয়োজন। সপ্তমীর দুপুরে পুজোমণ্ডপে গিয়ে হইহই করে প্রসাদ নিয়ে এলেন সকলে। বেশিরভাগ লালপেড়ে সাদা শাড়ি, কপালে বড় লাল টিপ। কাজের তোড়ে এলোমেলো চুল কিন্তু মুখ আলো করা জিতে যাওয়ার হাসি।
ছোট্ট পুজোঘরের সামনে একের পর এক গাড়ি এসে থামছে। বৌ-বাচ্চা-বয়স্ক বাবা-মা নিয়ে যৌনকর্মীদের ঠাকুর দেখতে আসছেন মধ্যবিত্ত বাঙালি। ভক্তিভরে নমস্কার করছেন। হাত পেতে প্রসাদ খাচ্ছেন। জোর করে চাঁদা দিচ্ছেন। দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না মেয়েগুলো। এঁরাই তো অন্য সময় তাঁদের পাড়ার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কপাল কুঁচকে, নাক সিঁটকে অচ্ছুতের মতো এড়িয়ে যায়। “তা হলে কি সামাজিক ছুঁৎমার্গ অনেকটা কাটল?” জিজ্ঞাসা করছিলেন ভারতীদি। অষ্টমীর দুপুরে খিচুড়ি-লাবড়া-পায়েসের ভোগ হাতে পেয়ে যেমন কল্যাণাদি, রিনাদিরা ছলছলে চোখে বলছিলেন, “আমাদের মতো মেয়েদের বাড়ি দুর্গাপুজোর ভোগ আসবে স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। আজ থেকে আর নিজেকে নিচু ভাবব না।” পুজোমণ্ডপের মাইকে তখন গমগম করে বাজছে“যা খুশি ওরা বলে বলুক, ওদের কথায় কী আসে যায়, ওরাই রাতের ভ্রমর হয়ে নিশিপদ্মের মধু যে খায়....।”
ক্রমে দশমী আসে। বেলা বারোটার আগেই পুজো ঘরের সামনে বরণডালা নিয়ে যৌনকর্মীদের লম্বা লাইন। শুরু হয় সিঁদুরখেলা। ভক্তিমেশানো বাঁধনহীন, রঙিন উচ্ছ্বাসের উৎসব। তাতে মিশে যায় হাসি-কান্না। লরিতে মূর্তি, সামনে তাসাপার্টি-ঢাক নিয়ে শুরু হয় যৌনকর্মী মেয়েদের এলাকা পরিক্রমা। যোগ দেন কালীঘাট, বৌবাজার, খিদিরপুরের মতো বিভিন্ন এলাকার যৌনকর্মী এবং আগ্রাওয়ালি বাঈজিরা। গন্তব্য, নিমতলা ঘাট। আর এক প্রস্ত সিঁদুর খেলা। লালে লাল ঘাট, নদীর জল। ওঁদের অস্তিত্বকে রাঙিয়ে জলে মিশে গেল প্রতিমাও।
|