শুধু পুজোয় চিঁড়ে ভেজে কই?
এই তত্ত্বটাই আরও জোরালো হয়ে দেখা দিল ২০১৩-র শারদোৎসবে। বৃষ্টির বাধা তুড়ি মেরে শহরের রাজপথে জনতার ঢলের নেপথ্যেও এই তত্ত্ব। নইলে দক্ষিণ কলকাতার দর্শনার্থীদের কী দায় পড়েছিল মানিকতলার অখ্যাত গলি হালসিবাগানের পুজো দেখতে আসার? রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট লাগোয়া এই গলির পুজোর কথা কয়েক বছর আগেও পাড়ার গুটিকয়েক লোকে জানত। এ বার তারাই আনন্দবাজার শারদ অর্ঘ্যের বিজয়ী। তিন বছর আগে সাবেক পুজো ছেড়ে থিম ধরেছিল তারা। সৃষ্টির দায়িত্বে আনকোরা দুই শিল্পী তুষারকান্তি প্রধান ও বাপ্পা হালদার। ফোম, জলের পাইপের মতো উপকরণের খেলায় দেবীর আবির্ভাবের কল্পজগৎ এ বার বাজিমাত করেছে। পাশের পাড়ায় লালাবাগান নবাঙ্কুরও শিল্পী প্রশান্ত পালের হাত ধরে জিতে নিয়েছে এই কুলীন পুরস্কার।
তবে শুধু থিম নয়! শহরের প্রথম সারির পুজো এখন একটা প্যাকেজ। তাই মিশর-রহস্যের মুক্তি উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান ছিল নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের মাঠে। এফডি ব্লকের পুজোয় আবার বোধনের আগেই খবরের কাগজের সাময়িকীর জন্য তারকা-খচিত ফোটো-ফিচার। যাদবপুরে পল্লিমঙ্গলের মাঠে ফ্রান্সের নামজাদা স্ট্রিট কমেডিয়ানরা আসর জমালেন। অর্থাৎ পুজোকে ঘিরেই ইদানীং দানা বাঁধছে আকর্ষক ইভেন্টও।
প্রচার কাড়তে এই সব নিত্য-নতুন স্ট্র্যাটেজি দেখে এক জন কিন্তু মুখ টিপে হাসছেন। কলকাতার থিম-পুজোর জাঁদরেল নেপথ্যনায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। সাবেক ঠাকুর আর চন্দননগরের আলোকসজ্জা আঁকড়ে থাকলে যে চলবে না, এটা অরূপ অনেক আগেই বুঝেছিলেন। সুরুচি সঙ্ঘের পুজোয় ২০০৩ সালের বিজ্ঞাপনটা এখনও অনেকের মনে আছে। ‘দু-তিন টাকায় কেরল ভ্রমণ’। অরূপ সগর্বে বলেন, “ওই হোর্ডিংয়ের সূত্রেই তো আমার সঙ্গে ঋতুদার (ঋতুপর্ণ ঘোষ) আলাপ হয়েছিল।”
আর এক পোড়-খাওয়া পুজোকর্তা শিবন্দিরের পার্থ ঘোষও মানছেন, অরূপই কলকাতা-হাওড়া সর্বত্র পুজোর হোর্ডিং বসানো শুরু করেন। কিন্তু পার্থবাবুর মতে, “হোর্ডিংটা আদপে দৃশ্যদূষণ ছাড়া কিছু নয়। এক নাগাড়ে প্রচারটাই জরুরি।” পুজোর জন্য কর্পোরেট-আনুকুল্য জিততে তাই বছর পনেরো আগে শিবমন্দিরই সবার আগে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর দরজায় দরজায় ঘুরে সিডি-উপস্থাপনা শুরু করে। এমন দূরদৃষ্টি ছিল ভবানীপুরের পুজোকর্তা উৎপল রায়েরও।
অরূপও হোর্ডিং-এ থেমে থাকেননি। কখনও মোবাইল ভ্যানে প্রচার করছেন, কখনও থিম সং খুঁজছেন। সুরুচির থিম-ভিত্তিক কলার টিউন, শান-শ্রেয়াদের গাওয়া ‘বাংলা আমার মা’ শ্রোতারা ডাউনলোড করলে পুজো কমিটির আয় হচ্ছে। সেই সঙ্গে চ্যানেলে চ্যানেলে চলছে মিউজিক ভিডিও। কিন্তু নাকতলা উদয়নের মাঠে মিশর-রহস্যের অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ টেনে খোঁচা দিতে ছাড়ছেন না অরূপ। তাঁর সরস মন্তব্য, “আমি বাবা, নিজের বিয়েতে অন্যের বউভাত করতে যাব না!”
নাকতলার পুজোটি রাজ্যের আর হেভিওয়েট মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের। অরূপের কথা শুনে পার্থবাবু হেসে বলছেন, “এ আবার কী কথা! প্রসেনজিৎ আমাদের বন্ধু। আমাদের পুজোর মাঠ থেকে ও কিছু করতে চাইলে কেন আটকাতে যাব?” দক্ষিণ কলকাতার এক পুজোকর্তা খোলাখুলি বলছেন, “থিমের পাশাপাশি নিজেদের পুজোকে বিশেষ ভাবে চেনাতে হবে। প্রতিযোগিতা থেকে দূরে থাকলে স্পনসর জুটবে না।”
মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম বাগবাজার বা ম্যাডক্স স্কোয়ার। “তবু বাগবাজারের ডাকের সাজ বা ম্যাডক্সের আড্ডাও তো এক রকম থিমই হল,” বলছেন কেউ কেউ। হেদুয়ার কাশী বোস লেন তাদের উঁচু প্রতিমার জন্য কয়েক দশক ধরে বিখ্যাত। তারাও ক্রমশ থিমে ঝুঁকছে। পুজো-কর্তাদের অনেকের কাছেই এখন সপ্তমীতে প্রতিযোগিতার ফল বেরোনো মানেই দশমীর মেজাজ। থিম আর বিপণনের কৌশলই যে এ কালের পুজোর প্রাণভোমরা। |