মান রাখতে গিয়ে প্রাণ যাওয়ার জোগাড়!
অর্থনীতির উথাল-পাথাল যে মণ্ডপের খুঁটি নড়িয়ে দেবে, ক’মাস আগেও তার আঁচ ছিল না। যথারীতি হরেক অভিনব চিন্তা-ভাবনা মগজে ভেঁজে কোমর বেঁধে ময়দানে নেমে পড়েছিলেন থিম-পুজোর হর্তা-কর্তারা। এখন ওঁদের মাথায় হাত। জাঁক করার টাকা মিলবে কোথায়, তা ভেবে তাবড় উদ্যোক্তাদের ঘুম ছুটেছে। থিমের টক্করে টিকে থাকার তাগিদে অন্য আড়ম্বরে কিছুটা আপস করার পথেও হাঁটতে চলেছেন অনেকে।
কারণটা স্বাভাবিক। সারদা-কাণ্ড থেকে শুরু। তার পরে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতির মুখ ব্যাদান, ডলারের সঙ্গে পাল্লা-দৌড়ে টাকার পিছিয়ে পড়া, শেয়ার বাজারে ধস কিংবা বিশ্ববাজারে ব্যারেলপিছু পেট্রোল বা আউন্সপিছু সোনার মূল্যবৃদ্ধি সংবাদপত্রের পাতা থেকে উঠে আসা এমন সব ঘটনাস্রোতেই অধিকাংশ পুজোকমিটির ‘ফান্ডে’ টান ধরেছে বিস্তর। একেই জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে গত বারের মান বজায় রাখতে প্রায় দ্বিগুণ খরচের আশঙ্কা। অথচ ‘স্পনসর’ সে ভাবে মিলছে না। কী রকম?
বিভিন্ন পুজোকমিটি-সূত্রের খবর: টাকার অবমূল্যায়ন, বিশ্ব-বাণিজ্যে মন্দা, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি বিবিধ কারণে বহুজাতিক সংস্থাগুলির তরফে পুজো প্রাঙ্গণে বিজ্ঞাপন দেওয়ার ঝোঁক কমেছে। কিছু সংস্থা পুজো স্পনসর খাতে কুড়ি থেকে পঁচিশ শতাংশ পর্যন্ত বাজেট ছাঁটাই করেছে বলে সূত্রের দাবি। উপরন্তু সারদা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে গুটিয়ে গিয়েছে অর্থলগ্নি সংস্থার রমরমা, এক বছর আগেও প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে যাদের ‘উজ্জ্বল’ উপস্থিতি নজর কাড়ত। রাজ্য জুড়ে বহু পুজোর জৌলুসের পিছনে তাদের আর্থিক বদান্যতার ভূমিকা গোপন কিছু ছিল না। এখন সেই উৎসও শুকিয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন পুজো-কর্তাদের বড় অংশ। |
বাজেট সামলাতে শেষবেলার হিসেব-নিকেশ।
বহরমপুরের এক নির্মীয়মাণ মন্ডপে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক। |
এমতাবস্থায় চোখধাঁধানো ‘থিম-মণ্ডপ’ গড়তে উদ্যোক্তাদের কালঘাম ছুটছে। কলকাতার ‘হেভিওয়েট’দের তো বটেই, জেলা এমনকী পড়শি রাজ্যের আয়োজকদেরও। বলতে গেলে, ওঁরা যেন বাঘের পিঠে সওয়ার। জমকালো থিম-পুজোর ময়দানে এক বার নেমে পড়ে আর পিছোতে পারছেন না। দর্শনার্থীদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়ে এখন ওঁরা বিলক্ষণ টের পাচ্ছেন, জাঁকজমক কমালে মণ্ডপের ভিড় উধাও হবে। প্রতিযোগিতায় নম্বর কমবে। তাতে পরের বছর কমিটির নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
অগত্যা থিম বাঁচাতে কোথাও ‘কাটছাঁট’ হচ্ছে উদ্বোধনের আড়ম্বর। কোথাও আলোকসজ্জার বহর কমছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাট উঠছে। কোথাও আবার বিজয়া সম্মিলনীর বালাই রাখা হচ্ছে না। যেমন বেহালার বড়িশা ক্লাবের মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে তুলনায় সস্তার কাঁচামাল দিয়ে। কমছে আলোও। অন্যতম উদ্যোক্তা অনিমেষ চক্রবর্তীর আক্ষেপ, “কর্পোরেট কোম্পানির বিজ্ঞাপনে ভাঁটা। চিট ফান্ডের টাকা নেই। বাজেট না কমিয়ে উপায় কী?” তা হলে থিম বাদ দিলেই তো হয়? অনিমেষবাবুর সাফ কথা, “থিম ছেড়ে সাবেকি পুজোয় ফেরা অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে পুজোর ভিড় আমাদের দিকে আসবেই না!”
কালীঘাটের সঙ্ঘশ্রীও সঙ্কটে। কমিটির সচিব শিবশঙ্কর চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বাজেট কমাতে উদ্বোধনের অনুষ্ঠান করছি না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল। মণ্ডপের আয়তন কমছে, আলোর কারিকুরিও আগের মতো হবে না।” মানিকতলা স্বপ্নার বাগান যুবকবৃন্দের কর্তা অভিষেক কুণ্ডুর মন্তব্য, “পুজোটা ভালো করতে চাইলেও সাধ্যে কুলোচ্ছে না। অথচ থিম থেকে সরে আসা মুশকিল।”
এবং অভিষেকবাবুর মতে, “রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া এখন পুজো করাটাই কঠিন!” বিজ্ঞাপনদাতা যে সব সংস্থা মারফত কর্পোরেট ও পুজোকমিটির মধ্যে আর্থিক লেনদেন হয়, এ প্রসঙ্গে তার একটির কর্তার দাবি: পুজো আয়োজনে লগ্নিসংস্থার তরফে অর্থের জোগান এ বারেও রয়েছে। “তবে তা প্রকাশ্যে নয়। রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকলেই টাকা পাওয়া যাচ্ছে।”— বলেছেন তিনি। রাজনৈতিক প্রভাবশালী উদ্যোক্তারা কী বলেন?
‘মন্ত্রীদের পুজো’ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন সর্বজনীনের উদ্যোক্তারা এটা মানতে রাজি নন। যেমন পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী ববি হাকিমের পাড়ার পুজো চেতলা অগ্রণীর কার্যনির্বাহী সভাপতি অন্তু ধরের বক্তব্য, “বিজ্ঞাপন আমাদেরও কমেছে। বাজেট ছাঁটাই হয়েছে ৩০-৪০ শতাংশ। শিল্পীকে বলা হয়েছে, কম খরচে ভালো কিছু গড়তে। চন্দননগরের আলোও বাদ।” নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘের পুজোর মূল উদ্যোক্তা তথা রাজ্যের আবাসন ও যুবকল্যাণমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের দাবি, “পাড়ার লোকই বরাবর টাকা জোগাড় করেন। আমরা কখনও অর্থলগ্নি সংস্থার ভরসায় ছিলাম না। তবে অন্য বিজ্ঞাপন অনেক কমেছে।” যদিও সে জন্য জাঁকজমকের পুজো থেকে সরে আসার কথা ওঁরা ভাবছেন না। “কলকাতার থিম-পুজোয় সুরুচি পথপ্রদর্শক। অন্য পথে তাই এগোতে চাই না।”— মন্তব্য অরূপবাবুর।
কর্পোরেট স্পনসরশিপের ছবিটা ঠিক কী রকম?
কলকাতার এক পুজো প্রতিযোগিতায় সমন্বয়কারী সংস্থার কর্ণধারের ব্যাখ্যা, “বিজ্ঞাপন ঠিক কতটা কমেছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। রাজ্যের বাইরে থেকেও মাল্টিন্যাশনালের টাকা আসে। টাকার দাম কমায় তাতেও টান ধরতে পারে।’’ অতএব সঙ্কট। যার গ্রাসে পড়েছেন ছোট-মাঝারি বাজেটের পুজোর ‘থিম-মেকারেরাও।’ বেহালার ২৯ পল্লির শিল্পী বিমল সামন্ত বলেন, “কাঁচামালের দাম বেড়েছে, সঙ্গে মজুরি। উদ্যোক্তারা অল্প বাজেটে ভালো জিনিস চাইছেন। সেই মতো থিম খুঁজে বার করাটা সহজ নয়।”
কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে নজর দেওয়া যাক বাইরে।
বহরমপুরের অন্যতম বড় দু’টি পুজো হল পাউন্ড রোড এবং পাউন্ড রোড বাগানপাড়া পশ্চিম। প্রথমটির কর্তা বৈদ্যনাথ ধরের পর্যবেক্ষণ, “বাজার খুব খারাপ। স্পনসর না-জোটায় কম বাজেটেই পুজো করতে হবে।” দ্বিতীয়টির তরফে দীপেন দাস বলেন, “কমিটির সকলে স্বর্ণশিল্পী। মাসচারেক কারও হাতে কাজ প্রায় নেই। বাজেট নিয়ে টানাটানি চলছে।” মেদিনীপুরের ‘বিগ বাজেট’ পুজো বার্জটাউন সর্বজনীনের দুর্গাপদ চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, “প্রতি বার বিজ্ঞাপন দেয়, এমন কিছু কোম্পানি এ বার মুখ ফিরিয়েছে। বলছে, নিজেদেরই অবস্থা খারাপ, পুজোয় টাকা দেব কী করে?” ঝাড়খণ্ড রাজধানী রাঁচির চন্দ্রশেখর আজাদ পুজো সমিতির সম্পাদক রামানন্দ ঠাকুরের বক্তব্য, “এখানে শিল্পীরা আসেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে। তাঁরা যা খরচা ধরেছেন, সামলানো মুশকিল।”
আবার ব্যয় বাড়লেও কলকাতার বড়িশা-স্বপ্নার বাগান-সুরুচির মতোই থিম-যুদ্ধে টিকে থাকতে বদ্ধপরিকর রাঁচির কোকর পুজোকমিটি। “দাম বেড়েছে বলে কি পুজো হবে না? পরিশ্রম করতে হবে। আগে পাঁচশো লোকের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হলে এ বার ছ’শো লোকের কাছে যাব।” প্রত্যয়ী ঘোষণা উদ্যোক্তা চঞ্চল চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। মেদিনীপুরের আর এক বড় পুজোর কর্তাও নিরূপায়— “অসুবিধে প্রচুর। তবু বাজেট নামাতে পারছি না। জাঁক কমলে যে পাড়ার মুখ পুড়বে!”
থিম বনাম ফান্ড। সাধ বনাম সাধ্য। লড়াইয়েরই আবহে দিকে দিকে পুজো প্রস্তুতি চলছে বাঙালির। |