তখন মোবাইল, ইন্টারনেট কি এটিএমের কথা কেউ ভাবতেই পারতেন না। ভরসা ছিল রেডিওই। কিন্তু আনন্দ কিছু কম ছিল না। শরত্ আসত কাশফুল , নীল আকাশ আর বন্যার আতঙ্কে। আর পুজো আসত রেডিওয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে। ‘মুলার’ কোম্পানির রেডিওটা থাকত বৈঠকখানা ঘরে। নবটা অন করলেই আগে আলো জ্বলত। কথা শোনা যেত বেশ কিছুটা পরে। তবে রেডিও-র ওই ঘরে ছোটদের প্রবেশ নিষেধ। শুধু বছরে একটা দিন আশ মিটিয়ে দেখতাম, শুনতাম সাহেব কোম্পানির বিলিতি রেডিওটাকে। সেটা মহালয়ার ভোর।
মনে আছে অত ভোরেও বাড়িতে অনেক লোক আসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ শুনতে। আর ঠিক সেই দিন থেকেই যেন পুজো শুরু হয়ে যেত।
এখন সারা বছর যখন তখন সেই চন্ডীপাঠ যদি মাইকেই শুনতে পাওয়া যায়,তা হলে সেই রোমাঞ্চ আর থাকে কী করে?” কিছুটা ক্ষোভের সুরেই বলছিলেন স্বরূপগঞ্জের আশি ছুঁইছুঁই ব্রজেন বিশ্বাস। তাঁর মহালয়ার স্মৃতি ভারি অদ্ভুত। গঙ্গার তীর ঘেঁষা গ্রাম স্বরূপগঞ্জ। গাঁ লাগোয়া খেয়া পারাপারের ঘাট। মহালয়ার ওই ভোরে নদীর দু’ঘাটের দুটি নৌকায় মাঝিদের নৌকাতে বাজত মহিষাসুরমর্দিনী। পর পর তিন বার শঙ্খধ্বনি দিয়ে শুরু হতো সেই অনুষ্ঠান। আর গ্রামের পুরুষেরা একে একে জড়ো হয়ে যেতেন নদীর ঘাটে। আশ্বিনের হালকা ঠান্ডায় ধুতির খঁুট দিয়ে গা মাথা মুড়ে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে এক দল মানুষ যখন নদীর পাড়ে বসে চন্ডীপাঠ শুনতেন, হঠাত্ দেখলে মনে হত সকলে যেন
ধ্যানে বসেছেন।
তবে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে রেডিও মেরামতের কারিগর রূপেন কর্মকার বলেন, “মহালয়ার আগের দিন রেডিও সারানোর ব্যস্ততা আগের থেকে বেড়েছে বই কমেনি। কারণ প্রথম দিকে যখন রেডিও ছাড়া অন্য কোনও মাধ্যম ছিল না তখন লোকে নিয়মিত রেডিও শুনতেন। পরে যখন রেডিও তার গুরুত্ব হারাল তখন মহালয়ার আগের রাতে তাকে সারানোর প্রয়োজন হল তবে সে সময়ে মহালয়াকে কেন্দ্র করে প্রচুর রেডিও বিক্রি হত। তবে সেসব এখন আর হয় না।”
হবে কী করে? নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের বি এ দ্বিতীয় বর্ষের ইন্দ্রাণী রায় কিংবা কৃষ্ণনগর সরকারি মহাবিদ্যালয়ের সদ্য ভর্তি হওয়া রূপসা ভট্টাচার্য সাফ জানিয়ে দেন, “অত সকালে উঠে ‘মহালয়া’ শোনা সম্ভব না। তা ছাড়া ওর সিডি তো পাওয়াই যায়। চাইলে যে কোনও সময়েই শুনতে পারি।” তবে কেউ কেউ আবার জানিয়েছেন, “ঘুম ভাঙলে মোবাইলের রেডিওতে যেটুকু পারা যায় শুনে নেব।” ভরসা বলতে সেটুকুই। |