প্রবন্ধ ১...
পুজো না থাকলেও আমার কিন্তু মহালয়া আছে
মার উৎসব আছে, পুজো নেই। অষ্টমীর অঞ্জলি বা দশমীর সিঁদুরখেলার পাটও নেই। সেই যে কোন কৈশোরে শুনেছিলাম, ‘রিলিজিয়ন হল জনতার আফিম’, তার পর থেকে প্রতিমায় প্রাণ-প্রতিষ্ঠায় আমার আস্থা চলে গেল। অথচ পারিবারিক পরিমণ্ডলে আমাদের ‘কোর-এরিয়া’টুকু বাদ দিলে, সকলেই আচারনিষ্ঠ। জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই তো জপ-আহ্নিক-উপোস দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। কিন্তু সে-সবে মন গেল না, ওই আপ্তবাক্যেই আটকে রইল। মার্ক্স যে একই সঙ্গে বলেছিলেন, ‘রিলিজিয়ন হল নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস, একটা হৃদয়হীন জগতের হৃদয় এবং প্রাণহীন অবস্থার প্রাণ’, সেটা জানতে আমার যৌবনকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল। অল্প বয়স আর অর্ধেক জানার সুবাদে তত দিনে আমি ঘোর তার্কিক। কথার পিঠে কথা বসিয়ে বিশ্বাসের আগে অন্ধত্বের বিশেষণ দেগে দিতে আমার এতটুকু দ্বিধা হয়নি। এখন কিন্তু হয়। কারণ, এখন এটুকু জানি যে, নাস্তিকতার মধ্যেও চোরা আফিমের কণা বেশ ভালই মাদকতা তৈরি করে। সে মাদকতা থেকে মুক্তি পাওয়া বেশ কঠিন, হয়তো অসম্ভব।
পুজো না থাকলেও আমার কিন্তু মহালয়া আছে। সে অবশ্য তিথি হিসেব করে আসে না। হঠাৎ এক দিন সকালে বারান্দার দরজা খুলে দেখি, রোদ্দুরের রংটা পাল্টে গেছে। অমনি বুঝি, আশ্বিন। তার মানে মহালয়া দুয়ারে প্রস্তুত।
আমার মহালয়া মানেই এক রকমের মনখারাপের অতীতে ফেরা। বয়স যত বাড়ে, এই অতীত-চারণাও তত বাড়ে। অবাক হয়ে আবিষ্কার করি, চার পাশে প্রিয় মানুষ যত আছে, তার চেয়ে কম নয়, যারা আর ধরাছোঁয়ার মধ্যে নেই। তাদের মধ্যে সবাই-ই যে বয়সে বড়, প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মেই নেই, এমন তো নয়। কত জন চলে গেছে পুলিশের গুলিতে, কত জন ভুল চিকিৎসায়, আবার কত জন মারণব্যাধিতে। সবাই ফিরে আসে শরতের আলো হয়ে, হিম-ছোঁয়ানো বাতাস হয়ে। এই ফিরে আসাটাই বোধহয় মহালয়া। সে বোধহয় আমাদের এটাও মনে করিয়ে দেয় যে, এমন সময় আসবে, যখন এই মধুময় ধরণীর ধূলিতে তোমার পায়ের চিহ্ন আর পড়বে না। আমার মহালয়ায় কোনও আনুষ্ঠানিকতা নেই। গঙ্গায় যেতে হয় না। পুরুতমশাইয়ের দ্বারস্থ হতে হয় না। শরতের আকাশ-বাতাসে ভেসে থাকা অদৃশ্য অতীতের কণাই আমার মন্ত্র হয়ে ওঠে, আমাকে ত্রাণ করে।
আমার বয়স যখন ষোলো-সতেরো, তখন আমার এক উনিশ-কুড়ির বন্ধু ছিল। দিনের আলোয় প্রকাশ্য রাজপথে পুলিশের গুলিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল, আর ওঠেনি। শরৎ এলে সেও ফিরে আসে। এখন আমার সন্তানের চেয়েও কত ছোট সে আটকে আছে সেই সদ্য যৌবনে। মনে হয়, এই তো এক্ষুনি এসে কড়া নাড়বে। অধৈর্য স্বরে বলবে, ‘কত দেরি করিস দরজা খুলতে?’
বাল্যকালে আমরা সমবয়সের ছয় বোন একসঙ্গে ঠাকুর দেখতে যেতাম, এক রকম জামা পরে। ইংরেজিতে ‘কাজিন’ বললেও আমরা একই অভিভাবকত্বেই ছিলাম, দূরত্ব ছিলই না। এক রকম জামায় তখন খুব বিরক্ত লাগত। এখন এক বার যদি ছয় বোন এক রকম শাড়ি পরে বেরোতে পারি, তার চেয়ে বেশি কিছু আর চাই না। তিন বোন কবেই চলে গেছে, আর তো কখনও ছয় বোন একসঙ্গে হওয়া হবে না, এক রকম পোশাকও আর কেউ দেবে না।
দেড় বছরের জন্য মাতৃহীনা এক কন্যা আমাকে মা মেনে এসেছিল। মারণব্যাধিতে চলে গেছে সাত বছর হয়ে গেল। পুজোর সময় তার জন্য আমাকে আর কিছুই কিনতে হয় না। মহালয়ায় সবচেয়ে আগে আসে সে। এত কাছে আসে, মনে হয় কখনও কাছ-ছাড়া হয়নি। রোগা-রোগা হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে আছে, যেমন থাকত অসুখের সময়। মনেই হয় না, এতগুলো বছর তাকে ছাড়াই কেটেছে।
পৃথিবীর বিরল কন্যাসন্তানদের মধ্যে আমি এক জন, মায়ের সঙ্গে যার কখনও ‘ভাব’ হয়নি। বস্তুত মায়ের সঙ্গে এক জীবনে আমার কোনও মতের মিল হয়নি। সে সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি কিছুতেই না। মায়ের সঙ্গে তর্ক করতে করতেই আমি বড় হয়েছি। আমাদের দুজনের সম্পর্কটা ছিল সমানে সমানে। মা আমাকে যতটা আশ্রয় দিয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি তৈরি করে দিয়েছে লড়াইয়ের জন্যে। পাঁচ বছরেরও বেশি মা-র সঙ্গে আর দেখা হয় না, আর হবেও না। কর্মঠ মা’কে রোগজীর্ণ হয়ে শুয়ে-শুয়ে কষ্ট পেতে দেখে বহু বার ভেবেছি, ‘এ বাঁচার অর্থ কী?’ আজ, চলে যাওয়ার পর অর্থটা পরিষ্কার হয়েছে। এখন বুঝতে পারি, আসলে সেই তর্ক, ঝগড়া আর বিবাদই ছিল বন্ধুত্বের নিবিড় প্রকাশ, যে বন্ধুত্ব আর কারও সঙ্গে হবে না কখনও। কথাটা এই মহালয়াতেই মা’কে বলতে চাই। জীবনে বলিনি তো কী! আমি জানি, মা ঠিক শরতের রোদ্দুর হয়ে আসবে, বকবে, এমনকী রাগও করবে। তবু এ বারেই মা’কে বলে দিতে হবে তাঁর মূর্খ সন্তান এত দিন পর বুঝতে পেরেছে, তুমিই ছিলে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এখন আর কেউ নেই, যে গলার স্বর শুনে বুঝে যাবে খিদে পেয়েছে কি না।
চারি দিকে অনুপস্থিত প্রিয় মানুষের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে, যে মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়ে যাই। সারা বছর ধরেই তারা সঙ্গে থাকে। কিন্তু একেবারে বিনা অনুষঙ্গে, শরতের আলোর রথে তারা এই সময়টায় একেবারে কাছে চলে আসে। সেই আমার মহালয়া।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.