চার দশক আগে আমরা তখন প্রাথমিকে ছাত্র। মফস্সলের সেই স্কুলে হেডমাস্টার ছিলেন হীরালালবাবু। তিনি একাধারে পড়াতেন, ছবি আঁকাতেন, গল্প করতেন। বলতেন, ‘রোজ খেলবি’। আমাদের শ’খানেক ছাত্রছাত্রীর সকলের বাবা-মা তাঁর বিশেষ পরিচিত ছিলেন। ক্লাস ফোর হয়ে গেলে স্কুল ছুটির পর তাঁর ঘরের কাচের আলমারিতে রাখা বইগুলি দেখাতেন। আবছা মনে পড়ে, বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ। বলতেন, ‘দেখ্, এ সব আমাদের অতীত, আমাদের চিরকালীন সম্পদও। ভুলিস না।’ ২৬ জানুয়ারি, ১৫ অগস্ট বা ২৫ বৈশাখ— এ সব দিনে তাঁর ভাষণ শেষ হত নির্ধারিত এই বাক্যবন্ধে: ‘আমরা আজ যে এখানে সমবেত হতে পারলাম, তার প্রধান কারণ আমাদের অতীত সাফল্য। এ স্কুল যাঁরা তৈরি করেছিলেন, তাঁরা আজ হয়তো অনেকেই নেই। কিন্তু তাঁদের সে উদ্যোগ-আয়োজন ভুলে গেলে অন্যায় হবে। অতীতকে কখনও ভুলে যেতে নেই।’
এখন, মহালয়ায় গঙ্গার বুকে এত মানুষের তর্পণরত ছবি দেখতে দেখতে বার বার মনে পড়ে হীরালাল মাস্টারমশাইয়ের কথা। মনে হয়, তাঁর জন্য তর্পণে নামি।
তখন শুধু মহালয়ার দিন নয়, আগের একপক্ষকাল জুড়ে তর্পণ চলত আমাদের পাড়ায়, ব্রাহ্মণপ্রধান অধিকাংশ বাড়িতে। পনেরো দিন ধরে চলা তর্পণ চূড়ান্ত রূপ নিত মহালয়ার সকালে। সে দিন গঙ্গার তীর থেকে ওঠা সুছন্দ ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ত ঘরে ঘরে: আব্রহ্মস্তম্বপর্য্যন্তং জগৎ তৃপ্যতু... আমরা জানতাম অভিভাবকদের অতীত-স্মরণ। শুধু কি অতীত? অতীত ছুঁয়ে গোটা বিশ্বের সব কিছুর মধ্যেই সম্পর্ক তৈরি করতে চায় তর্পণের মন্ত্র: ব্রহ্মলোক অবধি যাবতীয় লোক, সমীপে অবস্থিত জীবগণ, দেবগণ, ঋষিগণ, পিতৃগণ, অগ্নিষ্বাত্তাদি মনুষ্যগণ, পিতৃ-পিতামহাদি এবং মাতামহাদি সকলে তৃপ্ত হোন। এমন কী অতীত-কুলকোটীনাং, সপ্তদ্বীপনিবাসিনাং এবং ত্রিভুবনের স্থাবর-জঙ্গম সকল পদার্থ আমার প্রদত্ত জলে তৃপ্ত হোক। শুধু আমার স্বজন নয়, যাঁরা আমার বন্ধু ছিলেন এবং যাঁরা বন্ধু নন, তাঁরা সকলেই আমার দেওয়া জলগ্রহণ করে তৃপ্তি লাভ করুন। তখন অর্থ বুঝিনি। কিন্তু গঙ্গাতীরে ওই প্রান্তিক শহরের হাওয়া মহালয়ার সকালে তপর্ণ মন্ত্রের উদাত্ত বাণী ছড়িয়ে দিতে দিতে জানাত, পুজো এসে গেল।
তর্পণ কি শুধুই পিতৃপুরুষের উদ্দেশে তিল-জল দান? তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা? এখন মনে হয়, এই বিচ্ছিন্ন সময়ে, সকলের সঙ্গে বৈরিতা আর সন্দেহ-সম্পর্কের এই আকালে তর্পণ এক অন্য অনুভবের আয়োজন। যে অনুভবের ঘোর বুকের মধ্যে নিশ্চুপে আমরা আগলে রাখি। রাখি বলেই আজ এই আত্মসর্বস্ব সময় ভেঙেও আয়োজন চলে তর্পণের। তপর্ণও তো একার্থে জানিয়ে দেয় অতীতকে ভুলে যাওয়া অন্যায়। সম্প্রতি অধ্যাপক অরিন্দম চক্রবর্তী জেসন হিল-এর ‘বিকামিং আ কসমোপলিটান’ বইয়ের উল্লেখ করে (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০/৯/১৩) জানিয়েছেন, অতীত ভুলে ছিন্নমূল বাঁচার ভয়ংকরতা।
মহালয়ার তর্পণ আমাদের যাপনভূমিকে ছড়িয়ে দিতে চায় অতীতে, স্মৃতিতে। বলে বান্ধব-অবান্ধব সকলের সঙ্গে সংযোগ-সম্পর্কের কথা। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থে হিন্দুর ঈশ্বর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তিনি সর্বভূতময়। তিনিই সর্বভূতের অন্তরাত্মা।... কোনও মনুষ্য তাঁহা ছাড়া নহে, সকলেই তিনি বিদ্যমান।... তাঁহাকে ভালবাসিলে সকল মনুষ্যকেই ভালবাসিলাম। সকল মনুষ্যকে না ভালবাসিলে, তাঁহাকে ভালবাসা হইল না, আপনাকে ভালবাসা হইল না, অর্থাৎ সমস্ত জগৎ প্রীতির অন্তর্গত না হইলে প্রীতির অস্তিত্বই রহিল না।’ সকল জীবে সেই প্রীতির আয়োজন নিয়ে আমরা দেবীপক্ষে প্রবেশ করি।
অতীত বিস্মৃতিই তো জন্ম দেয় বিচ্ছিন্নতার। রবীন্দ্রনাথ ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ এক বক্তৃতায় বলছেন, ‘‘সভ্যতা-শব্দটার আসল মানে হচ্ছে, সভার মধ্যে আপনাকে পাওয়া, সকলের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি করা। সভা-শব্দের ধাতুগত অর্থ এই যে, যেখানে যেখানে আভা সেখানে আলোক আছে। অর্থাৎ মানুষের প্রকাশের আলো একলা নিজের মধ্যে নয়, সকলের সঙ্গে মিলনে।... এই জন্যেই মানুষ কেবলই আপনাকে আপনি বলছে, ‘অপাবৃণু’, খুলে ফেলো, তোমার একলা-আপনের ঢাকা খুলে ফেলো, তোমার সকল-আপনের সত্যে প্রকাশিত হও; সেইখানেই তোমার দীপ্তি, সেইখানেই তোমার মুক্তি।”
এরও তিরিশ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধে আমাদের ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ এনেছিলেন। ম্যাথু আর্নল্ডকে স্মরণ করে বলেছিলেন, ‘মানুষেরা এক-একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো, পরস্পরের মধ্যে অপরিমেয় অশ্রুলবণাক্ত সমুদ্র।’ বলেছিলেন, ‘আমরা যেন কোনো এক কালে একত্র এক মানসলোকে ছিলাম, সেখান হইতে নির্বাসিত হইয়াছি।’
মহালয়ার তর্পণের মন্ত্রে সেই নির্বাসন ভেঙে, বিচ্ছেদ ছিঁড়ে মানসলোকে এক মিলন-স্বরের দ্যোতনা তৈরির প্রয়াস আছে। ব্রহ্মা থেকে তৃণ পর্যন্ত সমগ্র জগৎকে এক, অভিন্ন দেখার এমন আয়োজন, বিশ্ব জুড়ে যোগাযোগ স্থাপনের এমন গহন আয়োজন বিরল।
বিষ্ণু দে-র ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ বইয়ে যামিনী রায়ের উদ্দেশে লেখা একটি কবিতা আছে। ১৯৫৯-এ যামিনী রায়ের জন্মদিনে লেখা সেই কবিতায় (চড়ক ইস্টার ঈদের রোজা) তাঁর অনুভব ছিল: ‘যন্ত্রণা অশেষ, আজ প্রেমী খোঁজে প্রেমের আস্তানা,
আশেপাশে জঘন্যের নগণ্যের মরীয়া উচ্চাশা,
সমস্ত কর্মের ক্ষেত্রে তুচ্ছতার অসহ্য পিপাসা,
ঘরে ঘরে জল চায়, অথচ ঘরেই সব নোনা’—
আরও তিক্ত, আরও নোনা সময়ে আমাদের বর্তমান যাপনে ভেতরে-ভেতরে অসহায় আর্তনাদ— বিচ্ছেদের, ভাল না-বাসাবাসির।
গঙ্গার ঘাটে তর্পণে না হয় না-ই গেলাম। তর্পণ মন্ত্রের অনুভব যদি জারি রাখতে পারি আমাদের নিত্য-চর্যায়! |