কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিণ্ডের কি বেশি কথা বলার অভ্যাস আছে? বেশি কথা এবং বাজে কথা? তাহা প্রমাণ করিতেই বোধ করি তিনি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মুখ্য সচিবদের একটি চিঠি দিয়া ইহা নিশ্চিত করিতে বলেন যে, মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনও তরুণকে যেন সন্ত্রাস মোকাবিলার অছিলায় অকারণে আটক রাখা না-হয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যকে চিঠি লিখিতেই পারেন। কিন্তু এমন ধরনের চিঠি স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম, যেখানে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাম্প্রদায়িক পরিচয় উল্লেখ করিয়া তাঁহাদের প্রতি ‘নরম মনোভাব’ লইতে আর্জি জানানো হইতেছে। ইহার ফলে যাহা একান্ত ভাবেই ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সমস্যা, তাহাতে সাম্প্রদায়িক রঙ চড়ানো হইল। প্রকারান্তরে এমন ইঙ্গিতও দেওয়া হইল যে, রাজ্যে-রাজ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু যুবকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে বৈষম্য করা হইতেছে। শিণ্ডে কি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করিয়া মন্তব্য করিয়াছেন? যদি করিয়া থাকেন, তবে এই সংশয় অনিবার্য যে, তিনি আগামী লোকসভা নির্বাচনে ইউপিএ সরকারের প্রতি সংখ্যালঘু ভোট আকৃষ্ট করার একটি ছেঁদো পদ্ধতি অনুসরণ করিতেছেন।
এ কথা সত্য যে, দেশে এক বিরাট সংখ্যক বন্দি বিচারের অপেক্ষায় কারারুদ্ধ এবং তাঁহাদের একটা বড় অংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু ইহার পিছনে অন্য সামাজিক কারণ কতটা দায়ী, পক্ষপাতিত্ব কতটা, তাহা তথ্য ও যুক্তি দিয়া বিচারের বিষয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাইকারি নির্দেশের ভিত্তি হইতে পারে না। শিণ্ডের মন্তব্য শুনিয়া স্বভাবতই তাঁহার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংশয় জাগে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে ইহা তাঁহার পক্ষে কেবল অকর্তব্য নহে, অত্যন্ত গর্হিত কাজ। রাজনৈতিক বাস্তববোধের নিরিখেও তাঁহার নির্দেশিকাটি সম্পূর্ণ ভুল। ইতিমধ্যেই সমাজবাদী পার্টি দাবি করিয়াছে, তাহারাই সন্ত্রাসের ‘ভুয়া’ অভিযোগে মুসলিমদের আটক রাখার প্রসঙ্গটি সর্বাগ্রে জাতির গোচরীভূত করিয়াছিল। উত্তরপ্রদেশের শাসনক্ষমতা হাসিল করিয়া সমাজবাদী পার্টি যে টাডা ও সন্ত্রাস-দমন আইনে কারারুদ্ধ বহু মুসলিম তরুণের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করিয়া তাঁহাদের বেকসুর খালাসের বন্দোবস্ত করে, ইহা তো সুবিদিত। তথাথিত জঙ্গি ধর্মনিরপেক্ষতা অনুশীলন বাবদেও শিণ্ডে বা তাঁহার দল কংগ্রেস অতএব কোনও একক কৃতিত্ব দাবি করিতে পারিবেন না।
বরং বিপরীত সম্ভাবনাটি অনেক বেশি মূর্ত। বিজেপি হিন্দুত্বের রাজনীতি অনুশীলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে ব্যবহার করিতে পারে। এখনই বিজেপি নেতারা সন্ত্রাসে অভিযুক্ত মুসলিম যুবকদের জন্য ইউপিএ সরকারের ‘মায়াকান্না’র উল্লেখ করিয়া নিন্দামুখর। যাহা একান্ত ভাবেই একটি আইনশৃঙ্খলার সমস্যা, তাহাকে সাম্প্রদায়িক রঙে রঞ্জিত করাটা কী ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা, সেই প্রশ্নের জবাবও চাওয়া হইতেছে। শিণ্ডে স্বভাবতই নিরুত্তর। ভারতে মুসলমানদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা ও পশ্চাৎপদতা একটি বহু-আলোচিত বাস্তব। সাচার কমিটির মূল্যবান রিপোর্টের পরে সেই সমস্যার স্বরূপ ও কারণগুলি সুপ্রতিষ্ঠিতও। আইন, প্রশাসন এবং বিচারের ক্ষেত্রেও তাহার প্রভাব থাকা সম্ভব, বস্তুত স্বাভাবিক। তাহার প্রতিকার অবশ্যই জরুরি। কিন্তু শিণ্ডের মতো নেতা তথা প্রশাসকরা সেই কঠিন কাজটিকে আরও কঠিন করিয়া তুলিতেছেন। |