পণ্ডিত বিষ্ণুশর্মা শিখাইয়াছিলেন, সর্বনাশ সমুৎপন্ন হইলে অর্ধেক ত্যাগ করিয়া বাকি অর্ধেক রক্ষা করিতে হয়। কংগ্রেসের প্রাজ্ঞ নেতারা নিশ্চয়ই পঞ্চতন্ত্র জানেন, কিন্তু তাঁহারা বোধ করি সুকুমার রায়ও পড়িয়াছেন, সুতরাং এই সত্যও অবগত আছেন যে, ব্যাকরণ শিংয়ের সেজোমামার আধখানা কুমিরে খাইয়া ফেলিলে বাকি আধখানা মরিয়া যায়। দণ্ডিত সাংসদদের আসন রক্ষা করিতে সরকার যে অর্ডিনান্স জারি করিতে তৎপর হইয়াছিল, রাহুল গাঁধী পাঁচ মিনিটের ঝটিকা সফরে তাহা ছিঁড়িয়া ফেলিবার আদেশ ঘোষণার পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা কেবল অর্ডিনান্স নয়, এ বিষয়ে পূর্বপ্রস্তাবিত বিলটিও প্রত্যাহার করিয়াছে। দেশের রাজনীতি ও শাসনতন্ত্রের পক্ষে ইহার পরিণাম শুভ। আদালতে দণ্ডিত হইলে আইনসভার সদস্যপদ চলিয়া যাইবে, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় শিরোধার্য না করিয়া তাহার বিপরীতে হাঁটিবার যে উদ্যোগে মনমোহন সিংহের সরকার তথা সনিয়া গাঁধীর দল মাতিয়াছিল, তাহা লজ্জাকর এবং অনৈতিক। রাষ্ট্রপতির সংশয় যদি সেই অপকীর্তি রোধের প্রাথমিক তাড়না হইয়া থাকে, তবে প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতীয় গণতন্ত্রের সাধুবাদ পাইবেন। শুধু এই চূড়ান্ত পরিণামটুকু যদি বিচার্য হইত, তবে রাহুল গাঁধীও সেই প্রাপ্তির শরিক হইতেন।
কিন্তু পরিণামকৈবল্যবাদী হইলে গণতন্ত্রের চলে না। নীতি, পদ্ধতি এবং আচরণ যথাযথ হওয়াও সমান আবশ্যক। এক অর্থে এই শর্তগুলি পরিণাম অপেক্ষা অধিক মূল্যবান। রাহুল গাঁধী সেই শর্ত আগাগোড়া ভাঙিয়াছেন। তিনি কংগ্রেসের সহ-সভাপতি। দল এবং, প্রধানমন্ত্রী সহ, সরকার তাঁহাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়া থাকে। প্রস্তাবিত আইন সম্পর্কে তাঁহার সংগত আপত্তি তিনি দলের কোর কমিটিকে অথবা প্রাসঙ্গিক যে কোনও মঞ্চে জানাইতে পারিতেন। তিনি লোকসভার সদস্যও, জনপ্রতিনিধি হিসাবে এবং দলের সদস্য হিসাবে আপন অভিমত যুক্তিসহকারে পেশ করিবার পক্ষে একটি গণতান্ত্রিক দেশে আইনসভাই শ্রেষ্ঠ পরিসর। আপন আপত্তি জানাইতে রাহুল গাঁধী এই মঞ্চগুলি ব্যবহার করেন নাই কেন? গত চার বছরে এই স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রক্রিয়াগুলি ব্যবহার করিতে তাঁহার বিশেষ উৎসাহ দেখা যায় নাই। অধিকাংশ সময়েই তিনি অ-দৃশ্য থাকেন, মাঝে মাঝে তাঁহার ধূমকেতুপ্রতিম উদয় ঘটে, কিছু উত্তেজনা সৃষ্টি করিয়া তিনি আবার দৃষ্টি ও শ্রুতির অগোচরে চলিয়া যান। এ ক্ষেত্রে তাহার সহিত যুক্ত হইয়াছে অহেতুক অসৌজন্য। যে ভঙ্গিতে ও ভাষায় অর্ডিনান্সটির বিরুদ্ধে তিনি তোপ দাগিয়াছেন, তাহা কেবল সরকার এবং দলের অমর্যাদা করে নাই, এই আচরণ তাঁহার নিজের পক্ষেও অসম্মানজনক। ইহাতে তরুণ নায়কের প্রতি দেশবাসীর শ্রদ্ধা জাগ্রত হইবে না। ‘অনুতাপ’ জানাইবার উত্তরকাণ্ড প্রধানমন্ত্রীকে ‘সন্তুষ্ট’ করিতে পারে, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় উহা পাদটীকা হইয়াই থাকিবে।
কংগ্রেস নেতারা এখন সমগ্র ঘটনাটিকে দলের গণতান্ত্রিক মানসিকতার বিজ্ঞাপন হিসাবে জাহির করিতে ব্যস্ত। রাহুল গাঁধী তিরস্কার করিবার পূর্বমুহূর্ত অবধি গণতান্ত্রিক মানসিকতা কেন জাগ্রত হয় নাই, সেই অসুবিধাজনক প্রশ্নটি না-হয় উহ্য থাকিল। কিন্তু যাহা ঘটিয়াছে, তাহাতে দলের মুখ উজ্জ্বল হয় নাই। দৃশ্যত, অর্ডিনান্সটি সম্পর্কে দলের ভিতরে অনেকেরই আপত্তি ছিল। এমন অনুমান অসংগত নহে যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সেই তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সেই সকল আপত্তি উপরমহলের আদেশে বা সংকেতে অন্তরে নিহিত থাকিল, উপরমহলের হুকুমে মুহূর্তে বাহিরে আসিয়া পড়িল— ইহা কি পুতুলনাচ হইতেছে? গণতন্ত্র নহে, এই কাহিনিতে অন্য এক তন্ত্রের স্বরূপ প্রকট। মনে পড়ে, সপ্তদশ শতকে ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই নাকি বলিয়াছিলেন, ‘আমিই রাষ্ট্র’। কংগ্রেস এবং তাহার নায়কনায়িকাদের বোঝা দরকার, ইহা একবিংশ শতক। |