মিলের আবহে নয়া বাণিজ্যের দিশারি প্রণব
তিনি বললেন, বেলজিয়াম-ভারত ‘হীরক-সেতু’কে জাগিয়ে তোলার কথা। দু’দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর সাদৃশ্যের কথা ব্যাখ্যা করলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের রফতানির নতুন নতুন ক্ষেত্র খোঁজার কথাও বললেন।
আজ এ ভাবেই বেলজিয়াম ও ভারতকে নানা সুতোয় গাঁথলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর এই সফরকে নিছক তাত্ত্বিক স্তরে সীমাবদ্ধ না রেখে ভারতের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বেলজিয়ামের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতা বিষয়ক পাঁচটি চুক্তিপত্রও সই হল। যে প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব বেণু রাজামণি বললেন, “গত এক বছর ধরে ভারতের উচ্চশিক্ষার পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন মঞ্চে কথা বলে চলেছেন রাষ্ট্রপতি। আজ সেই লক্ষ্যে একটি পদক্ষেপ করা হল।”
বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ছবি: এএফপি।
সফরের দ্বিতীয় দিনে আজ বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী ইলিও ডি রুপো-সহ বিভিন্ন নেতার সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করলেন প্রণববাবু। ১৮৪৮ সালে তৈরি, বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন পার্লামেন্ট ভবনটিও ঘুরে দেখলেন। রাজপ্রাসাদে তাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হল। সফরসঙ্গী বিদেশ মন্ত্রকের কর্তারা বলছিলেন, গত কাল রাষ্ট্রপতিকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে এসে যে ‘অভূতপূর্ব কূটনৈতিক নজির’ গড়েছেন বেলজিয়ামের রাজা-রানি, তারই ইতিবাচক ফল দেখা গিয়েছে আজকের দ্বিপাক্ষিক আলোচনায়। স্থির হয়েছে, আগামী মাসে বেলজিয়ামের ৩০০টি বাণিজ্যিক সংস্থা ভারতে আসবে বিনিয়োগের লক্ষ্যে। আজকের বৈঠকে শুধু অর্থনৈতিক অগ্রগতিরই সাড়া মেলেনি, প্রণববাবুকে বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের অন্তর্ভুক্তির দাবিকে সমর্থন করবেন তাঁরা। পরমাণু জ্বালানি সরবরাহকারী গোষ্ঠী বা এনএসজি-তে ভারতকে সদস্য করার ক্ষেত্রেও সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছেন বেলজিয়ান নেতৃত্ব।
রাষ্ট্রপতির কথায়, “ইউরোপে এবং অন্যান্য দেশে গত কয়েক বছরে কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ২০১২-য় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের গতি ধরে রাখা যায়নি। আশা করব, ২০১৩ সালে যে গতি ফিরে পাওয়া গিয়েছে, তা ধরে রাখা সম্ভব হবে।” কী ভাবে তা করা যায়, তার একটি নীল নকশাও আজ বেলজিয়ান নেতৃত্বের সামনে তুলে ধরেছেন দীর্ঘদিন অর্থ ও বিদেশ মন্ত্রকের গুরুদায়িত্ব সামলানো প্রণববাবু।
ভারত জানে যে, আর্থিক মন্দার জেরে বেলজিয়ামে উৎপাদন শিল্প এখন কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। ফলে ভারত এত দিন যে সব খনিজ আকরিক এবং কাঁচামাল বেলজিয়ামে রফতানি করত, তাতেও ভাটা পড়েছে। তাই রফতানির ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে নতুন নতুন দিক খুঁজে বার করার চেষ্টা হয়েছে আজকের বৈঠকে। সনাতন হিরের বাণিজ্যের বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন প্রণববাবু। তাঁর কথায়, “ভারতীয়রা বেলজিয়ামের হিরের বাণিজ্যে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছেন। এ দেশের অর্থনীতিতে তার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। সে ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট। কিন্তু দু’দেশের মধ্যে বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যে নতুন নতুন ক্ষেত্র খোঁজার প্রয়োজন রয়েছে। জীববিদ্যা, সবুজ প্রযুক্তি, ওষুধ শিল্প, পরিকাঠামো, তথ্য-প্রযুক্তিক্ষেত্রে সমঝোতা ভবিষ্যতে নিবিড় করা যেতে পারে।”
অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি দু’দেশের রাজনৈতিক চরিত্রের সাজুয্য সম্পর্কেও ব্যাখ্যা দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। বহুদলীয় শাসনব্যবস্থার ভারতে ভোটের ফলাফলে যে খণ্ডিত জনমত (ফ্র্যাগমেন্টেড ম্যান্ডেট) অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, তা স্বাভাবিক বলেই মনে করেন ‘চাণক্য’ প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০০৪ সাল থেকে ইউপিএ জোটের অন্যতম এই কাণ্ডারীর মতে, খণ্ডিত জনমত ছাড়া আধুনিক ভারতের গত্যন্তর নেই। কেন? রাষ্ট্রপতি জানাচ্ছেন, ভারতের একটি লোকসভা নির্বাচনে ৭৮ কোটি ভোটারকে ৫৪৩টি ভোটকেন্দ্রে যদি ভাগ করা হয়, তা হলে সর্বসম্মতি তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। এই বিশাল জনগোষ্ঠী ভাষা, রীতিনীতি, আদবকায়দায় বিবিধ ভাবে বিন্যস্ত।
এ ক্ষেত্রে বেলজিয়ামের সঙ্গে ভারতের মিল রয়েছে বলেই তাঁর বিশ্বাস। বেলজিয়ামে নির্বাচনের পর প্রায় কুড়ি মাস লেগেছিল একটা সরকার তৈরি করতে। ভারতের মতো জোট সরকার গড়ার চেয়েও এখানে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, ভাষার বিভিন্নতা, বিভিন্ন জাতির চাহিদাকে বশ মানিয়ে ঐকমত্য তৈরি করা। ফরাসি, জার্মান এবং স্থানীয় ভাষার মোড়কে নানা আশা-আকাঙ্ক্ষাকে এক মঞ্চে আনতে কম বেগ পেতে হয়নি প্রধানমন্ত্রী ইলিও ডি রুপো-কে। বিভিন্ন ভাষাভাষীর দেশ বেলজিয়ামই এখন ২৮টি দেশ সম্বলিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুখ হয়ে উঠেছে। বৈচিত্রকে আত্মীকরণ করেই। ২০১৪ সালে ভারতের মতো বেলজিয়ামেও সাধারণ নির্বাচন। এটাও আর একটা কাকতালীয় মিল। এখানকার সেনেটের চেয়ারম্যান স্যাবিনে ডি’ বেথুন অবশ্য সার্বিক ভাবেই দু’দেশের রাজনৈতিক চরিত্রের মিলের কথা বলছিলেন। শুধু তা-ই নয়, স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে প্রণববাবুর দেওয়া বক্তৃতা উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, “যে ভাবে রাষ্ট্রপতি গণতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করেছেন, তাকে আমরা শ্রদ্ধা করি।”
বিবিধের মাঝে মহান মিলনের সনাতন সুরটি এ ভাবেই ঘিরে রয়েছে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বেলজিয়াম সফরকে।

কলকাতা বন্দরকে সাহায্যের হাত
কলকাতা বন্দরকে পুনরুজ্জীবিত করতে বেলজিয়ামের সঙ্গে সহযোগিতার রাস্তা গড়লেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে আজ এ ব্যাপারে নীতিগত ঐকমত্য হয়েছে। ওই বৈঠকে প্রণববাবুর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন জাহাজমন্ত্রী জি কে ভাসান। অবস্থানগত ভাবে কলকাতা বন্দরের সঙ্গে বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্প বন্দরের মিল রয়েছে। স্কেলড নদীর এই বন্দর সমুদ্র থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার ভিতরে। ফলে নিয়মিত পলি তুলে বড় জাহাজ ঢোকার মতো নাব্যতা বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ কলকাতা বন্দরের মতো অ্যান্টওয়ার্প বন্দরেরও রয়েছে। কিন্তু কলকাতায় যেখানে বড় জাহাজ ঢোকা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছে, সেখানে অ্যান্টওয়ার্প মাল ওঠানামার নিরিখে ইউরোপে দ্বিতীয়। এই কারণেই বেলজিয়ান বন্দর বিভাগের সাহায্যে কলকাতা বন্দরের পুনরুজ্জীবনে জোর দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।

পুরনো খবর :



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.