মোড়কটা সাংস্কৃতিক দৌত্যের। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার সূত্র খুঁজতেই আজ টিনটিনের দেশে পা রাখলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়! দিল্লি থেকে দুপুরে রওনা হয়ে আজ রাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘মুখ’ ব্রাসেলস-এ এসে নামল রাষ্ট্রপতির বিশেষ বিমান। বেলজিয়ামের রাজা ও রানি বিমানবন্দরে এসে স্বাগত জানালেন প্রণববাবুকে।
ইতিহাস বলছে, এই প্রথম কোনও ভারতীয় রাষ্ট্রপতি এলেন বেলজিয়ামে! আগামী তিন দিন এখানেই ঠিকানা তাঁর। তার পর উড়ে যাবেন তুরস্ক। বেলজিয়ামে রাষ্ট্রপতির প্রধান কর্মসূচি হল, বিরাট এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন। বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে বসে এই সাংস্কৃতিক মহাযজ্ঞ ‘ইউরোপালিয়া’। এ বার সেখানে আমন্ত্রিত দেশ ভারত। ভারতীয় সিনেমা থেকে কারুশিল্প, নৃত্য থেকে চিত্রকলা এক বছর ধরে এখানে চলবে ঢালাও প্রদর্শন। |
অভ্যর্থনা। ব্রাসেলসের বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পর
রাজা ফিলিপের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। বুধবার। |
কিন্তু সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ছাড়াও ভারতীয় রাজনীতির চাণক্যের এই সফরের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। দেশজ রাজনীতিতে প্রণববাবু যেমন দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন, তেমনই তাঁর কূটনৈতিক অভিজ্ঞতাও অগাধ। মনে করা হচ্ছে, এই সফরে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের দেশকে তুলে ধরার প্রয়াস করবেন রাষ্ট্রপতি। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী প্রণববাবু যেমন ইউরোপের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বুঝে নিতে চাইবেন, তেমনই বাণিজ্যের নতুন নতুন ক্ষেত্রেরও অন্বেষণ করবে তাঁর টিম।
বর্তমান প্রেক্ষিতে কেন গুরুত্বপূর্ণ বেলজিয়াম সফর?
কারণ, আর্থিক মন্দা কাটিয়ে এখনও পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ইউরোপের দেশগুলি। স্বাভাবিক ভাবেই সেই দেশগুলিতে ভারতের রফতানি উদ্বেগজনক ভাবে কমেছে। তৈরি হচ্ছে বাণিজ্যিক লেনদেনের ঘাটতি। টাকার দামের ক্রমাগত পতনে রফতানির চেয়ে আমদানির পিছনে ব্যয় গিয়েছে বেড়ে। অথচ ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে জার্মানির পরে বেলজিয়ামই ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য-অংশীদার। বেলজিয়ামে রফতানিকারী দেশগুলির তালিকায় ভারত রয়েছে ছ’নম্বরে। মূল্যবান পাথর, গয়না, খনিজ দ্রব্য, বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ, বস্ত্র রফতানিতে ভারতের এত দিনের স্বচ্ছন্দ গন্তব্য ছিল বেলজিয়াম। আবার, ভারতে বিনিয়োগকারী দেশগুলির মধ্যেও বেলজিয়াম বেশ গুরুত্বপূর্ণ নাম। সাম্প্রতিক অতীত বলছে, সে দেশের মাটিতে ভারতের বিনিয়োগের পরিমাণ ছাপিয়ে গিয়েছে ভারতে বেলজিয়ামের বিনিয়োগকে। বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিভিন্ন বেলজিয়ান সংস্থাকে কিনে নিয়েছে ভারতীয় সংস্থাগুলি।
কিন্তু তা সত্ত্বেও গত এক বছরে ভারত-বেলজিয়াম বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৯ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক মন্দার প্রভাবে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতোই বেলজিয়াম ভারত থেকে আমদানি কমিয়েছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় চিরাচরিত কাঁচামালেরও প্রয়োজন কমছে সে দেশে। এই পরিস্থিতিতে বাণিজ্যের নতুন নতুন ক্ষেত্র খোঁজার কাজটাও শুরু করে দিয়েছে নয়াদিল্লি। সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়ানোর পাশাপাশি সেই কাজটাও করবে রাষ্ট্রপতির এই সফর। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব বেণু রাজামণির কথায়, “দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যক্ষেত্রকে আরও সম্প্রসারিত করার লক্ষ্য রয়েছে। রেল, বন্দর নির্মাণ, শক্তি, জৈব রসায়ন, গাড়ি শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি, পরমাণু প্রযুক্তি বিনিময় নিয়েও সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে।” |
রাষ্ট্রপতির অন্যতম সফরসঙ্গী হয়ে এসেছেন জাহাজমন্ত্রী জি কে ভাসান। পরিবহণ ক্ষেত্রে বেলজিয়ামের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হওয়ার কথা। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের অন্যতম শরিক বেলজিয়াম পরিবহণ ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত ভাবেই যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাইছেন ইতিহাসের একনিষ্ঠ ছাত্র প্রণব মুখোপাধ্যায়। ব্রিটেনে রেল ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়েছিল এই বেলজিয়ামই। এমন একটি ঐতিহ্যবাহী দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষেত্রে দৃঢ় সমন্বয় গড়ে তোলাই লক্ষ্য নয়াদিল্লির।
বেলজিয়াম সফরকে আরও একটি কারণে গুরুত্ব দিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। ইউরোপের রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ কূটনীতিতে এই দেশের বরাবরই কৌশলগত ভাবে আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। ব্রাসেলস ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদর দফতর। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট-সহ ইইউ-এর বহু অফিস রয়েছে এখানে। উপরন্তু, ইইউ কাউন্সিল-এর প্রেসিডেন্ট পদ রয়েছে বেলজিয়ামের হাতে। পরমাণু শক্তি, ইস্পাত ও কয়লা-সহ ইউরোপের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শরিক এই দেশ। কূটনীতিকদের মতে, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, এবং জার্মানির মতো ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণেও বেলজিয়ামের গুরুত্ব যথেষ্ট। তাই মনে করা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর প্রথম দীর্ঘ বিদেশ সফরটির জন্য বেলজিয়ামকে চিহ্নিত করে সামগ্রিক ভাবে ইউরোপীয় দেশগুলির কাছেও একটি সদর্থক রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
|