কলেজে আমার নাম ছিল ‘সাধের লাউ’
রোম্যান্টিক হিন্দি গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত ছেড়ে বাবুল সুপ্রিয়কে হঠাৎ লোকসঙ্গীতের অ্যালবাম করতে হল কেন?
কেন নয়? কলেজ ফেস্টে লোকগীতি গাওয়ার সুবাদে আমাকে সবাই ‘সাধের লাউ’ বলেই ডাকত। ছোট থেকে এই গানই গেয়েছি। লোকগীতির সঙ্গে নাচের যোগ বরাবরের। তাই ভাবলাম খোলা মাঠের লোকগানকে যদি বদ্ধ ঘরের ডিস্কের তালে নিয়ে আসি, তবে উইকএন্ডে ডিস্কে যাওয়া জেন ওয়াইকে বাংলা মেঠো গানের তালে নাচাতে পারব। সেই কারণেই এই অ্যালবাম।

তাই বলে লোকগানের অ্যালবামের নাম ‘হোয়াট দ্য ফোক’?
আজকের গানের সময়টাই বলছে, ‘ফোক ইজ ফোক ইজ ফোক’। অবশ্যই মজা করে বলা। আমি ঘুরিয়ে কথা বলতে চাই না। আমি রিস্ক নিতেই ভালবাসি। তবে বড় কথা এটাই, যে সংস্থা এই অ্যালবাম প্রকাশ করেছে, তারা নাম নিয়ে কোনও আপত্তি করেনি। মিউজিক ওয়ার্ল্ডের বন্ধ হয়ে যাওয়ার যুগেও তারা যে সিডি প্রকাশ করার কথা ভেবেছে, এর জন্যে আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।

কিন্তু কলকাতার কয়েকটা সিডি বিক্রির দোকান বলছে এই অ্যালবাম যে দারুণ বিক্রি হচ্ছে এমন নয়। আপনি কী বলেন?
দেখুন, অ্যালবাম প্রকাশের তিন দিনেই এর গান এক নম্বরে পৌঁছেছে। আর বেশি কী বলব?

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেবেন আপনার নতুন অ্যালবাম?
নিশ্চয়ই। উনি আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে খুব ভালবাসেন। আগের বার ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মোহনবাগান দিবসে উনি আমায় ‘দিল মে বাজে গিটার’-এর পরে রবীন্দ্রনাথের গান গাইয়েছিলেন।

আপনার ফেসবুক প্রোফাইলে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার জন্য অজস্র অনুরোধ জমা হচ্ছে। অথচ আপনি তো রবীন্দ্রনাথের গান খুব একটা বদল করে গাননি। বদল না করেও এই গান গেয়ে জনপ্রিয় হওয়া যায়?
জনপ্রিয়তার জন্যে বদল করা ঠিক নয়। রবীন্দ্রনাথের গানে কথা বা সুরের বদল করলে সেখানে আমি নিশ্চয়ই আপত্তি করব। কিন্তু যদি জ্যাজ-এর ব্যবহার করা হয়, তাতে ক্ষতি কোথায়? রবীন্দ্রনাথের গান ওল্ড ওয়াইন নয়, ওল্ড গোল্ড। তিনি নিজ গুণেই আন্তর্জাতিক। বিলিতি সুর অনুসরণে গান তৈরি করেছেন। দেবব্রত বিশ্বাস, কিশোরকুমার এক এক জন তো এক এক ভাবে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন। এতে দোষটা কোথায়?
রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে তা হলে লোকগানের মতো এমন ডান্স মিক্স তৈরি করতে চাইবেন আপনি?
নাহ্। সেটা আমি পারব না। নির্মলচন্দ্র বড়ালের নাতি বলেই পারব না। আমি ও ভাবে গানটা শিখিনি।

আমি বলতে চাইছি ‘মায়াবনবিহারিণী’ বা ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’-র ক্ষেত্রে বদলটা কি আপনার ভাল লেগেছে?
নিশ্চয়ই। কারণ আমি মনে করি গান আর বিজ্ঞান দু’টোই এক। দু’ক্ষেত্রেই এক্সপেরিমেন্ট না করলে বিষয়টা এগোবে না। নতুন জিনিস তৈরিও হবে না। ওই দু’টো গান গাওয়ার মধ্যেই আসলে একটা সৎ প্রচেষ্টা ছিল। ছবির বিষয়ের খাতিরেই রবীন্দ্রনাথের গানে গিটারের ঝঙ্কার শোনা গিয়েছিল।

এক্সপেরিমেন্ট করার নামে সঙ্গীত পরিচালকেরা এখন গান গাইতে আরম্ভ করেছেন। মুম্বইতে প্রীতম প্রোডিউসার চাইছেন বলে অনেক শিল্পীকে দিয়ে একটা গান রেকর্ড করিয়ে শেষে গানটা নিজেই গাইছেন। এটাকে একজন গায়ক হিসেবে আপনি কী ভাবে দেখছেন?
প্রীতমকে নিয়ে অনেকের অভিযোগ থাকলেও যে গানের জন্যে যেটা করা উচিত ও সেটাই করছে। দর্শক সেটাকেই গ্রহণ করছেন। ওর গানও হিট করছে। জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় আজ কলকাতায় অনুষ্ঠান করলে দশ হাজার লোক জমা হয়। এটা তো মানতেই হবে। মানুষ এটাই চাইছে। আর ডি বর্মন-ও তো নিজের গান মাঝে মাঝে নিজেই গেয়েছেন।

আপনার এমন কোনও অভিজ্ঞতা আছে যে স্টেজে গায়ক হিসেবে উপস্থিত থেকেও গান গাওয়ার সময় অন্য কারও হাতে আপনাকে মাইক তুলে দিতে হয়েছে?
অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে বিদেশে লাইভ পারফর্ম্যান্সে ‘খাইকে পান বনারসওয়ালা’ গানটি বরাবর অমিতজি গাইতেন, আমি আর সুদেশ ভোঁসলে পিছনে গলা মেলাতাম। কারণ মানুষ ওই গানে অমিতজিকেই শুনতে চাইত। এটা মানতেই হবে। আজও লোকে চায় রণবীরই স্টেজে ‘বদতমিজ্ দিল’ গাক, সেটা বেসুরো হলেও ক্ষতি নেই। তবে এখন স্টুডিয়োয় শাহরুখ বা রণবীর গাইলে কেবল তাঁদের সুরটা ঠিক করে দেওয়া হয়।

এখন কি তবে সফ্টওয়্যার, গায়ক তৈরি করে?
এটা খুব সত্যি কথা। সুর ঈশ্বর, সুর ছুঁতে হবে এখন আর এ কথা খাটে না। অ্যান্থারাস, মেলেডাইন এমন সব সফ্টওয়্যার, যা আপনার সুরহীন গলায় ‘সা’ বসিয়ে দিতে পারবে। এখন তাই বাথরুম সিঙ্গাররাও গায়ক। দর্শককে চিট করে তাঁরা জনপ্রিয় হচ্ছেন। প্রচুর টাকার বিনিময়ে অনুষ্ঠান করছেন।

সেরকম একজন শিল্পীর নাম বলুন না...
না দেখুন, আমি খুব আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। নিজের কাজ নিয়ে থাকতেই ভালবাসি। পরনিন্দা পরচর্চা করলে ভাল গান গাওয়া যায় না। আমার কী গরকার অন্য শিল্পীর সমালোচনা করার...

আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার জন্যেই কি ‘সিঙ্গারস অ্যাসোসিয়েশন’-এ জাভেদ আখতার, গুলজার-এর মতো মানুষের সঙ্গে আপনি যোগ দিতে পারলেন না?
আমার একটা অন্য মত আছে। অন্য কেউ সেটা মানল কি না তাতে কিছু আমার আসে যায় না। আমার মনে হয়েছিল কিছু সিঙ্গার নিজের জীবনে সব কিছু পাওয়ার পর নতুন গায়কদের প্রথম থেকেই এই অ্যাসোসিয়েশনের কনট্র্যাক্টের মাধ্যমে একটা জটিল পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছেন। এত টাকা দিলে তবেই কোনও গায়ক গান গাইবেন, এই গান ডাব করা যাবে না ইত্যাদি নানা শর্ত। প্রথম থেকে গান গাওয়ার ক্ষেত্রে এত শর্ত থাকলে তারা গানটা কখন গাইবে বলুন তো? আজও কর্ণ জোহর তাঁর ছবির জন্যে যদি আমায় সব ক’টা গান গাইয়ে নিয়ে কম পয়সা দেন, আমি কিছু মনে করব না।

আপনি কিন্তু সফ্টওয়্যারে তৈরি বিখ্যাত শিল্পী অথচ গায়ক নন এমন নাম এড়িয়ে যাচ্ছেন...
আতিফ আসলাম। উনি গায়ক নন। কিন্তু ওঁর গান যে সুপারডুপার হিট, তার ক্রেডিট ওঁর টেকনিশিয়ান, এরিক পিল্লাই-য়ের।

তা হলে কি নতুন শিল্পীরা গানের ক্ষেত্রে সফ্টওয়্যার ব্যবহার করবেন না?
তা নয়। সফ্টওয়্যারের সুবিধা তো নিতেই হবে। ক্রিকেটের কথাই ধরুন না। নতুন ব্যাটের দৌলতে যদি একটা সেঞ্চুরিও আপনি করে ফেলেন, তা বলে কি কভার ড্রাইভটা জানবেন না? ঠিক তেমনই গানের ক্ষেত্রেও শুধু সফ্টওয়্যার নয়, সাধনারও প্রয়োজন। তাতে হয়তো বিখ্যাত শিল্পী হওয়া যায়, কিন্তু প্রকৃত গায়ক হওয়া যায় না।
কিন্তু বিখ্যাত গায়ক হয়েও তো দেখা যাচ্ছে এ বার পুজোয় তাঁদের নতুন অ্যালবামের সংখ্যা পড়তির দিকে। এটা কেন?
সেটার জন্যে মানুষ দায়ী। মানুষ এখন একশো কুড়ি টাকা দিয়ে চিকেন রোল খান। অথচ ওই টাকায় সিডি কেনেন না। উলটে রাস্তা থেকে সস্তা দামের সিডি কেনেন। তার ফল তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এ বছর পুজোর গানের অ্যালবামের সংখ্যাই কমে গিয়েছে। মিউজিক কোম্পানিগুলো কেনই বা রিস্ক নেবে? মানুষ যদি পাইরেটেড সিডি কেনা বন্ধ করেন, তবেই অ্যালবামের সংখ্যা বাড়বে।

আপনাকে কিশোরকুমার, কুমার শানুর ক্লোন বলা হয়। এটাকে কী ভাবে নেন?
এটা তো মিডিয়ার তৈরি ধারণা। আমার সঙ্গীত জগতের প্রথম দিকেই এটা খুব বেশি বলা হত। তখন তো আমার নিজের গানও ছিল না। আসলে ক্রিকেটারদের যেমন খবরের কাগজ পড়তে বারণ করা হয়, আমিও সাত বছর হল খবরের কাগজ পড়ি না। ঘুম থেকে উঠে মোবাইল অ্যাপসেই সব খবর পেয়ে যাই।

এ মা! তা হলে কি আপনি এই সাক্ষাৎকারটাও পড়বেন না?
না, আমি জানি আনন্দবাজার পড়তে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। মুম্বইতে এখন মা-বাবা আছেন। ওঁরা আনন্দবাজার নেন। সেই সুবাদে আমারও পড়া হয়ে যাবে।

এই পুজোয় অভিজিৎ-এরও একটা লোকগীতির অ্যালবাম বেরিয়েছে। তিনি লোকগীতি প্রসঙ্গে একটা ইন্টারভিউয়ে বলেছেন, ‘মানুষের মন বোঝাটা শিল্পীর বড় দায়।’ আপনিও কি তাই মনে করেন?
হ্যাঁ, আমিও মনে করি মানুষের মন বোঝাটা শিল্পীর বড় দায়। সেইজন্যই মানুষের মনে গেঁথে আছে এমন সব জনপ্রিয় লোকগীতি নিয়েই অ্যালবাম করেছি। যাতে তাঁরা গানের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারেন। অভিজিৎদা সিনিয়র শিল্পী। আমি ওঁর লোকগীতি শুনতে চাই। ইচ্ছে আছে ওঁর কাছ থেকে অ্যালবাম চেয়ে এনে শুনব। মুম্বইতে তো পাওয়া যায় না।

বাড়িতে তো আপনি একাই থাকেন?
হ্যাঁ, একাই। মেয়ে বিদেশে পড়াশোনার জন্য গিয়েছে। আমি মনে করি, শিল্পীদের হাজারো ব্যস্ততাতেও দিনের কোনও একটা সময়ে একা থাকা উচিত। তখনই কেবল নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়। নৈঃশব্দ্যের গন্ধ আমায় টানে।

একা থেকে এত সুন্দর প্রেমের গান কেমন করে গান?
প্রেম করি বলেই গাইতে পারি। প্রেম নতুন কি পুরনো এমন কিছু ভাবি না। মেয়েদের মন বোঝা ছেলেদের কাজ নয়। কিন্তু আমি রোজই প্রেমে পড়ি।

কার প্রেমে?
সেটা বলব না....

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.